ছোট গল্প— জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
রুহ বা রুহ
একটা একটা করে পক্ষ প্রস্থান করে... বয়স বাড়ে। একদিন আবিষ্কার করি— প্রায় নিয়মিতই সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি পরে শুচ্ছি রাতে, মেঝেতে কম্বলের ওপর চাদর পেতে। ধাতুর শৌখীন সিগারেটের ডিবের বদলে একটা পানের ডিবের প্রয়োজন অনুভূত হয়। আর গভীর রাতে উঠে গিয়ে পান না ফেলতে পারার কারণে, হাতের কাছেই একটা তেমন কিছু... কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো।
সম্ভাব্য কিছু নিয়ম আর পদ্ধতির মধ্যে এক অসম্ভব যাপন, অথবা অসম্ভব কিছু নিয়ম আর পদ্ধতি অন্বেষণ করতে করতে স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা-- সারাংশ বুঝি না, কিন্তু অস্তিত্ব বা সত্তার একটা বড়ো অংশ এই নিয়েই। সচেতনে অথবা অবচেতনে। এ এক অদ্ভুত ক্ষয়লোক, অবশ্যম্ভাবী। কে কার এবং কীসের বিরুদ্ধে রেজিস্ট করছে, একটু না বুঝতে চাইলে এমনিই হাতের চকের মতো বেবাক ফুরিয়ে যাবে। বিলীন হয়ে যাবে...
প্রাচীন শিব মন্দির পোড়ো হয়, পরিত্যক্ত হয়। ইট-সুরকির ওপরে এমনভাবে বট-অশ্বত্থ গা ঝাড়া দিয়ে বেড়ে ওঠে,অঞ্চলের মানুষ ভুলেই যায়... কবে শেষ নিত্যপুজো করেছিল কেউ সেই মন্দিরে।
হঠাৎই একদিন জানা যায়— তিন শতাব্দী আগে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ... চুরি হয়ে গেছে। পোড়ো মন্দির এক শূন্যগর্ভ অবশেষ, এবারে শুধু ভেঙে পড়ার অপেক্ষা।
কেউ ভেঙে ফেলে না এগিয়ে এসে, আর সে-ও ভেঙে পড়ে না। দৈব। লিঙ্গ অন্তর্হিত হলে কী হয়?(!) নির্মাণ নিজেই এক লোকদেবতার মতো বট-অশ্বত্থের সজ্জা ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।
কে এসে পূজা-অর্চনা করে গেল, কে এসে আচার-নিষ্ঠার প্রদর্শন করে গেল— আর কিছু আসে যায় না।
আরাধ্যেরা বিলুপ্ত হলে, ঈশ্বরও বিস্মৃত হন। অথচ এই অবশেষের এমন দৃঢ় উদাসীন উপস্থিতিও কেউ উপেক্ষা করতে পারছে না।
মন্দির বটে... কিন্তু কোন দেবতার? ভিতরে কে আছেন? কারো থাকার কি আবশ্যিকতা আছে আজ আর?... বুড়া মন্দির নিজেই নিরবধি...
সম্ভাব্য নিয়মের মাঝে অসম্ভব যাপন? নাকি অসম্ভবকে অন্বেষণ করতে করতে নিজস্ব স্বাভাবিকতার মূর্ত প্রতিরূপ?
অসম্ভবের কথা ভাবতে ভাবতে দুটো অন্য শব্দ ঘুরপাক খায়— উত্তরসম্ভব, পুনরসম্ভব।
একতলা পরিত্যক্ত বাড়ি, একদা খাজাঞ্চিদের পরিবার থাকত। এখন শুধু দেওয়াল আর ছাদ নিয়ে রঙজ্বলা ইমারৎটা রয়ে গেছে। কোন শরীকের ইচ্ছে হল মেরামৎ করাবে। একটা আধুনিক শব্দ আছে— রেনোভেট। সেই করাবে, পুরনো চেহারার এস্থেটিক ব্যাপারগুলো বাঁচিয়ে রেখে। কলঘরের কাছে, পলেস্তারা খসে পড়া একদিকের দেওয়াল ছেনি দিয়ে ঠুকে ঠুকে কেউ পুরো পলেস্তারাই চটিয়ে ওঠানোর কাজ করছিল। হঠাৎই একটা ঘা মারার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ হল। কলঘরের ছাদের একটা অংশ! সেই অংশ খসে পড়তেই, ভাঙা ছাদ থেকে এক ঝলক রোদের আলো এসে পড়ল কলঘরের শ্যাওলা ঢাকামোমেঝের ওপর। সেই একটা অংশ ভেঙে পড়তেই, আরো কিছুটা অংশ ভেঙে পড়ল... তারপর আরো কিছুটা। ক্রমে পুরো কলঘরেরর ছাদটাই ভেঙে পড়ল। মজুরগুলো আচমকা ছাদ খসে পড়া দেখেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব ফেলে ধুপধাপ সেখান থেকে সরে বাইরে চলে এলো। ঠিক তারপরেই চোখের সামনে কী থেকে কী ঘটে গেল! পুরোবাড়িটারই এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত সব ঘরের ছাদ একে একে ভেঙে পড়তে থাকল। রোয়াক, দালান, ভেতর-বাড়ি... সব। শুধু কোনো কোনো ঘরে কড়িবর্গার কিছু অংশ রয়ে গেল-- কোনো বিশালাকায় প্রাগৈতিহাসিক সামুদ্রিক প্রাণীর পাঁজরের হাড়ের মতো। সিনেমার স্পেশ্যাল এফেক্টের মতো, একটার আঘাতে একটা... একটার অনুরণনে আর একটা ভেঙে পড়ল। বাবুদের সংরক্ষণ করে রাখতে চাওয়া এস্থেটিক অতীত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল দিনের আলোয়! সকলের সামনে! যারা ছিলাম, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম... অবিশ্বাস আর ঘোর নিয়ে। যেন ভূতের ভেলকি! এত বছর ধরে পরিচিত খাজাঞ্চি-বাটির হলদেটে রঙজ্বলা ইমারৎ... রোদ-জল-ঝড় সহ্য করে কাটিয়ে দিল। আর আজ সামান্য হাতুড়ির ঠোকায় এইভাবে...
মজুরটা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। কাঁদো কাঁদো মুখ। ওর মনিব, মনিবের মালিক... তারও ওপরে শরীকদের ভ্রুকুটি। স্বাভাবিক।
শরীকদের একজন ওখানেই ছিল। ইচ্ছে করে তাকে শুনিয়েই বললাম— সরে আয় রফিক, এ কোনো মানুষের কাজ নয়। আমরা সবাই দেখেছি... তোর একার ঘাড়ে পড়বে না। তোদের কারো ঘাড়েই না।
সেই শরীকও আমাকে চিনত। থমথমে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল।
জিজ্ঞেস করলুম— আগে এমন ঘটতে দেখেছ কখনো?
তার মুখ দিয়ে কথা সরল না।
বললুম: দুনিয়া আসলেই দীনের। বখত আর নসীবের কাছে সবাই দীন। সবাই ভাবে তদবীর, ভেতরে ভেতরে কতটা যে তকদীরে ধরে রেখেছে...
'ওসব তোমারই মাথায় আসে...' — বলে, সে দ্রুত কানে ফোন ধরে কাউকে কিছু বলতে বলতে চলে গেল। লোক আসবে, ব্যবস্থা নেবে। রেনোভেটের ধারণা, পদ্ধতি, ভবিষ্যৎ... সব বদলে গেছে হাতুড়ির এক ঘায়ে।
খাজাঞ্চি-বাটির দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে শুধু... দুপুরের রোদে ঝলমল করছে তার খসে পড়া নকাব, খুলে পড়া আব্রু।
বুড়া মন্দির, না বুড়ার মন্দির, না বুড়া পীরের... জানি না। তার নসীবে কোনো রেনোভেশন নাই। মাশাল্লাহ... পাখ-পাখালিরাও বাসা করে আছে, সরীসৃপেও।
______
এড়িয়ে আর উপেক্ষা করে মানুষ কত সহজে চলে যেতে পারে, অথবা উদাসীন থাকতে পারে... ফেলে দিতে পারে Deprioritized-এর তালিকায়। একটা 'পরে হবে'-র সিদ্ধান্তে মুড়ে— এই সকল কিছু পর্যবেক্ষণ, সহন, অধ্যায়ন আর অনুশীলন করতে করতে একপ্রকার সার্ভাইভাল স্কিল জন্মে গেছে। জন্মে যায় আমাদের। ছোটোবেলা থেকেই তো দেখছি— উদ্বেগ, অনুভূতি, রাইটিয়াসনেস, মূল্যবোধ, প্রতিক্রিয়াশীলতা... সব কিছুরই একটা 'এটা-ওটা'-র ব্যাপার আছে। সবার জন্য সব কিছু না। সবার থেকে সব কিছু প্রত্যাশাও করা যায় না। যাবে না।
একই পরিস্থিতিতে, থেকে থেকে অন্য কাউকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যেতে দেখি। আগে হীনমন্যতা জন্মাত, প্রবল হতাশাও। এখন এসব স্নায়ুও অসাড় হয়ে গেছে।
কেউই যে খুঁজবে না... খোঁজে না। এই উপলব্ধিটা মাঝে মাঝে তীব্র কোনো তারে বেজে ওঠে। যা নেই... সেই স্থানেও মানুষ ব্যথা অনুভব করে। তাকে বলে ফ্যান্টম পেইন।
একটা অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত চেহারার দোতলা বাড়ি, যে কোনো পথ চলতি লোকেরই নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু নজরে পড়ত, তার একতলার ঘরের একটা 'প্রায় সর্বক্ষণ' খোলা রাখা দরজার জন্য। দরজার সামনে সব সময়ে বিভিন্ন বয়সের এক পাল বেড়াল বসে থাকত। দরজা দিয়ে দেখলে... ঘরের ভেতরেও। একটি মাত্র খাট, তাতেও বেড়াল বসে। দিনের বেলা, এক বৃদ্ধকে কেরোসিনের স্টোভে রান্না করতে দেখা যেত ঘরের মাঝে বসে। আর কিছু বেড়াল বসে থাকত তাকে ঘিরেও। সন্ধ্যেবেলা দেখা যেত বৃদ্ধ বিছানায় বসে অথবা বালিসে ঠেস দিয়ে আধশোয়া, তখনও একই রকম বেড়াল দিয়ে ঘেরা।
আসতে-যেতে দেখতাম, মনে হত এ আমারই ভবিষ্যৎ। একটা সময়ে অভিভাবকদের যেতেই হবে মঞ্চ ছেড়ে। তারপর থেকে...
Some souls are destined to be that way. Inevitably so.
তারা কাদের সঙ্গে আছে, কীভাবে আছে... এসব কিছু বদলে দেয় না। তারা একাই। একটা অন্য কম্পাঙ্কে থেকে যায়। কেউ বা কারা সেই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে অবস্থান করলে তবেই তাদের পাশে থাকতে পারবে... That is how it is. That is how it would be.
গুরুত্বহীন থাকার অভ্যেস থেকেই ক্রমে স্পষ্ট হয়ে যায়। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যই আমার নয়। যে বা যিনি আমার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অবস্থান করতে সক্ষম... তাদের দিকে চেয়ে থাকি।
কখনো শ্রমণ, কখনো বায়স, কখনো বেড়ালের মতো।
ক্ষুদ্র এক মৃৎপ্রদীপের মতো জ্বলতে থাকা প্রত্যাশার অস্তিত্ব অস্বীকার করি না। আবার এও মনে হয়-- মন্ত্রহীনং, ক্রিয়াহীনং, ভক্তিহীনং... আন্তরিকভাবেই তো বলেছি বার বার। সবার মাঝে, সমবেত কন্ঠের মাঝে এই একজনের বলাও কি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে? নিবেদনের মাঝে নিজের মতোই গুরুত্বহীনং জুড়ে দিতে মন চায়। মূর্খের শ্লোক-চেতনা। শুভংকরী কী করবেন?-- হয় বুঝে নেবেন,না হয় উপেক্ষা করবেন। এই বাইনারির বাইরে আর কী থাকে? অপেক্ষা?
কোন পক্ষে আর্তি বেশি? কোন পক্ষে অন্তরায়?... এসব মাঝে মাঝে মনে আসে... ধ্রুপদকল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বসে থাকি নতজানু, অথবা ভ্রূণমুদ্রায়। শুভংকরী... চোখ চেয়ে দেখো...
হেমন্তের কুয়াশা আর হলুদ ফিলামেন্টের আলো মেখে প্রকট হয়ে উঠছেন মন্দিরের অবশেষ, তাঁকেই আশ্রয় করে ঘুমোচ্ছে বিহঙ্গকুলের সন্তান-সন্ততি। তারই কোটরে ডিম পাহাড়া দিচ্ছে মা কালাচ। তারই চূড়ায় ডেকে উঠছে তক্ষক। ধ্রুপদকল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আত্মপরিচয়ের স্মৃতিতে মগ্ন হন লোকদেবতা। এয়ো স্ত্রীদের সুর করে গাওয়া মঙ্গল গানের কলি ভেসে আসে হেমন্তের রাতে। অবশেষের আত্মা, ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকেন নৈঃশব্দ্য ধারণ করে একা। উপাচার অথবা উপাচারকারীদের অভাব নয়... কত জনকে রক্ষা করা যেত, অথবা গেল না— সেই আফসোসে। তাঁর দীর্ঘশ্বাস, বট-অশ্বত্থের পাতায় সরসর শব্দ তুলে যায়। তাঁর অশ্রু, শিশির-বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ে অবশেষের পাদদেশে, হেমন্তের শিশিরে ভেজা মাটিতে।
শুভংকরী!... একবার চোখ চেয়ে দেখো...
______
দুটো শব্দ মঞ্জিরা-মৃদঙ্গের তালে খুব নেচে উঠল যা হোক... গোরাচাঁদ, আর গৌড়চন্দ্রিকা।
গৌড় আর গৌরাঙ্গ একে অপরের সঙ্গে মিশে আছে। অথচ মিশে থেকেও পৃথক। ভাগবৎ মাহাত্ম্যের সকল প্রসঙ্গ ললাটে স্পর্শ করে পাশে রাখি। গবাক্ষ দিয়ে দেখি বনবিবি আর দক্ষিণ রায়কে স্মরণ করতে চলে যাচ্ছে একদল মানুষ। অরণ্যের গহনে এক মৌচাককেই হঠাৎ মনে হয় অমৃতকুম্ভ। এরাও তার সন্ধানে যাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। একদিন সঠিক কুম্ভের সন্ধান পাবে-- সাত রাজার ধন।
"অমৃত লইয়া কী করবা মুসাফির? তা পাইলেই বা কী করবা? না পাইলেই বা কী করবা?"
দুটো দাঁতের অভাবে সৃষ্টি হওয়া ফাঁকের বিদ্রূপ নিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে কালু ফকির। বুজরুক শব্দের মৎলব তো কবেই বেঁকে গেছে। ওর বুজরুকি এখন আর কে শোনে!
ওর অনুপস্থিত দাঁতের মতো না বলা কথার ইঙ্গিতটাও বুঝতে পারি। ওর দুটো নেই, আমার দুটো ঈষৎ উঁচু।
কালু আবার রেশ টেনে বলে— 'বারে বারে আর আসা হইব না... হালায় আইস্যাই বা কী করবা? না আইস্যাই বা কী করবা?
আমার এবার সত্যিই হাসি পেল, বললুম... চা পাইলে খাইবা, বিস্কুট চাইলে তাও পাইবা...
আমাদের দুজনের অট্টহাস্য শুনে তিন চারটে কাক কা-কা করতে উড়ে গেল। দু-তিন জন পথ চলতি লোক তাকিয়ে দেখতে দেখতে চলে গেল।
আমার বাবার এক সম্পর্কে কাকা, আমাকে একবার ডেকে বলেছিলেন— বামুনের ছেলে, ওদের সঙ্গে এত মেশো কেন?
সেই কাকা গত হলেন এমন অসুখে, কেউ দেহ ছুঁতেও এলো না। সেই কালু আর আমি ছিলাম, আর কালুর দুই স্যাঙাৎ।
যখন বেঁহুশ জ্বরে উপুর হয়ে পড়ে আছি। একা। একবার মনে হল— আমার যখন এই হাল, ওরাও তাহলে গেল বোধহয়।
মাঝে শুধু মনে পড়ে, কোন এক অল্পবয়সী মেয়ে ডাল-ভাত-তরকারির থালা রেখে দিয়ে যেত। সে মেয়ের মুখ কেমন ভুলে গেছি। কোমর অবধি এক-মাথা চুল। পায়ে নূপুরের শব্দ তুলে আসত।
পরে কালুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে বলল— তাকেও নাকি এমনই কেউ এক বেলা খাবার দিয়ে যেত। পরে লোককে জিজ্ঞেস করতে বলে— জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল...
এমনিতেই কালু 'বুজরুক', আর আমি গুরুত্বহীনং... এসবের সত্যি মিথ্যে নিয়ে ভাবার মতো অসম্ভব সময় নষ্ট সভ্যতার ইতিহাসে আর কিচ্ছু হতে পারে না।
আমরা কেয়ামতের অপেক্ষা করি। আঁধি-তুফানের অপেক্ষা করি। দাঙ্গার খবরে লোকজনের বীভৎস নাচ দেখার অপেক্ষা করি।
কালু আর আমি- আদতে ভীতু মানুষ। নদীর চরে চলে যাই দুজনে ডিঙা ভাসিয়ে। যাতে কটা দিন কেউ আর খুঁজেই না পায়।
চরে বসে অনেকক্ষণ গাঁজা টানার পর বুজরুক বলে: একডা হাচা কথা বল, ও হালায় পাথর চুরি কইরা কত ট্যাকা পাইবা?
কোন পাথর চুরির কথা বলছে বুঝতে আমার অসুবিধে হল না। অনভ্যস্ত হাতে দম টানার দমকে কাসতে কাসতে বললাম: তুই বাজে মরবি একদিন!
বলেই জিভ কামড়ে ফেললাম। বুজরুক চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল হাসতে হাসতে। মাথা নীচু করে বসে রইলাম আমি...
কালু বুঝতে পারল মনে হয়। বলল: ভালোটা আর কে মরে এ দুনিয়ায়? সে সব আছিল কিছু পীর পয়গম্বর...
গাঁজার আগুন নেভে। রসদে টান পরে। ডিঙা ঘুরিয়ে ফিরতেই হয় রাত গভীর হওয়ার আগে। দুই বুজরুক... একে অপরকে বিস্তর ক্ষমা-ঘেন্না করে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি একসাথে... একা একা।
বাইশগজী প্রাকারের ওপর দিয়ে কালো ঘোড়া রুস্তম ছুটে যায়। হাবসী মেহবুবের কালো ঘোড়া। একের পর এক জ্যাৎস্নাস্নাত রাত্রি পেরিয়ে ছুটেই চলেছে রুস্তম।
তার খুরের শব্দের একটা নিজস্ব দ্রুত লয় আছে। পাখোয়াজের দ্রুত লয়ের মতো। দূর থেকে এসে স্পষ্ট হয়, আবার দূরে সরে যায়... নির্দিষ্ট চক্রে।
প্রাকারের ওপারে একের পর এক ফানুশ উড়তে থাকে... হলুদ, লাল, কমলা... তাদের প্রতিবিম্ব দুলে ওঠে ঝিলের জলে। দুলে ওঠে খঞ্জরের মতো বঙ্কিম চন্দ্রের প্রতিবিম্ব।
তক্ষকের মতো অন্ধকারে ডেকে ওঠে কেউ... কখনো মনে হয় নুরানি, কখনো মনে হয় রুহানি।
নুরানির কসক ক্রমে রুহানিতেই স্থির হলে বুনো শেয়ালদের রবও মনে হয় বিসমিল্লাহ।
দিওয়ানা আশিকরা গোল গোল ঘোরে শাহজাদীর সৌধ ঘিরে...
সে কী বেইন্তেহা গুজারিশ তাদের ইবাদতে... সে কী আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড সারেন্ডার স্প্রী... তীব্র উন্মত্ততা!
সত্যিই এরা মানুষ নয়... মানুষের সাধ্যাতীত এতটা ভালোবাসায় মরে মরে ফিরে আসা।
তাদের উন্মত্ততাকে আরো কয়েক স্তর ওপরে নিয়ে যায় রুস্তমের অপার্থিব হ্রেষাধ্বনি। সবাইকে লাফ দিয়ে পার করে চলে যায়... মেহবুবকে পিঠে নিয়ে।
কে কার জন্য কুরবানী দিতে এত মরিয়া? কে ফিদাই ? কোথায় আশ শাহীদ?
একসময়ে এই আকুতির বিষাদ-ঝংকার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, অসহনীয় হয়ে ওঠে। এসবের মাঝে থাকতে ভালো লাগে না। ভয় হয়।
তল্পিতল্পা গুটিয়ে সব ছেড়ে পালাই সেসব ছেড়ে।
"আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে... ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে..."
ধুম জ্বরে ডিলিরিয়ামের মতো একই কথা বিড়বিড় করে জপতে জপতে পালাই... এইসব থেকে দূরে।
সবাই গেছে বনে... যাব না এই মাতাল সমীরণে -- এই সিদ্ধান্তই যে শাশ্বত! আমার তো কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়...
আজন্ম প্রতীক্ষা জড়িয়ে বট-অশ্বত্থ গজিয়ে গেছে... শেকড় বিঁধিয়ে অভ্যন্তরে, শিরা-উপশিরায়। রাতে পেঁচাও ডেকে ওঠে-- ইয়াকুব, ইয়াকুব...
বুজরুক সহি গলৎ -- নিজের মতো বুঝে নেয়।
আমিও কাউকে কিছু বোঝাই না।
একজনকেই কিছু কিছু বলি এখনো। আর কাউকে না। কিচ্ছু না।
_____
এক সর্বংসহা অস্তিত্বকে ঢেকে দিয়ে বল্মীক বেড়ে ওঠে। ভেতরে কে থাকে? আর কারা আশ্রয় করে?
কেউ ভাবে সাপ, কেউ ভাবে মেঠো ইঁদুর।
এক সর্বংসহা অস্তিত্বকে বৃত্তাকারে ঘিরে এক শ্বেত বলয় রচনা করে শাঁখের গুঁড়ো। ঠিক যেমন শাঁখের গুঁড়ো পড়ে থাকতে দেখা যায় শাঁখাড়িদের পাড়ায়, শাঁখা তৈরির সময়ে।
এই বল্মীক স্তর থেকে কি কেউ চাইলেই বিমোচন করতে পারে কারোকে?
গণ্ডির বাইরে থেকেই দেখে লোকজন, একদা তিনি কেমন ছিলেন... সেই সব কথার চর্চা হয়। কার কথা... তাও সকলে স্পষ্ট বুঝতে পারে না। কেউ ছিলেন... আছেন, বল্মীক স্তরের আড়ালে।
জ্যৈষ্ঠের তাপে মাটি ফাটে। সাপের খোলস পাওয়া যায় ঢিবির কাছে। শেয়ালেরা সুঁকে সুঁকে চলে যায় ভয়ে ভয়ে, দূরে গিয়ে সুর করে ডেকে ওঠে। সেই ডাক শুনে আরো দূরে ডেকে ওঠে এক পাল কুকুর... সে ডাকের নিজস্ব সুর, নিজস্ব রব। গ্রামের এয়ো স্ত্রী দূর থেকে শালপাতায় সাজিয়ে রেখে যায় নৈবেদ্য। সুর করে করে দেবীর মাহাত্ম্য পাঠ করে। দূর থেকেই। ঝড় ওঠে... গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। বর্ষা নামে -- ঋতুতে অকালে। লাল মাটির কিছু অংশ আর্দ্র হয়ে ছাপ পড়ে ঋতুস্রাবের মতো। এভাবেই দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বনানী, এভাবেই দেখতে দেখতে পিঠস্থান চিনেছে প্রান্তিক মানুষ।
কিছুটা ভয়, কিছুটা অজ্ঞান, কিছুটা বিশ্বাস আর কিছুটা আত্মসমর্পণ নিয়ে।
এমনই এক সর্বংসহা রহস্যময়ী অস্তিত্বকে ঘিরে বল্মীক জেগে থাকে।
বিপ্রতীপ কোণের কিংশুকবৃক্ষ নির্দিষ্ট পক্ষে লোহিত আভরণ ধারণ করে, ঢেলে দেয় সব তাঁর পায়ে। লাল ফুল কবরীতে গুঁজে চলে যায় কাঠুরিয়ার মেয়ে। বাতাসা কুড়িয়ে নিয়ে চলে যায় রাখাল ছেলে। আর কাটা ফলের টুকরো চুরি করে শাখামৃগ।
বিপ্রতীপ কোণে বসে হাঁটুতে নুনের পুলটিস সেঁক দিতে দিতে বুজরুক বলে... খোদার মোজেজার শেষ নাই!
ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, মনে হয় সমান্তরাল এক অবস্থানে বসে বুজরুকও সেই সব কিছুই দেখছে যা ওই পলাশ গাছ দেখে এসেছে এতকাল। হয়ত আমাকেও দেখেছে কখনো, সব ফুল ঢেলে দিতে এভাবেই। সব কথা যে বলতেই হবে... এমনও তো না। আমিও সচেতনভাবে এড়িয়ে যাই। পালটা প্রশ্ন করি না বলে বুজরুকও বুঝে নেয়-- কথা পৌঁছে গেছে সঠিক স্থানে।
বুজরুকের এই বন-বাদার ভালো লাগে না। কাঁধের ঝোলা আর কুপিটা হাতে নিয়ে উঠে চলে যায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে। আমাকে ডাকে না, পেছন ফিরে দেখেও না। আমিও পিছু নিই না ওর। অনেকটা দূরে গিয়ে বলে:
অন্ধকার নামলে সাপ বেরোয় বামনার পো... জহের মুরীদও চিনে না, দিওয়ানাও চিনে না। একদিন বাজে মরবা!
হা-হা-হা করে হাসতে হাসতে চলে যায় কালু বুজরুক। তার হাসির শব্দ শনশন করে ওঠে পলাশে-শিমুলে পাতায় পাতায়। প্রাচীন গুহাচিত্র অথবা সভ্যতার সিলমোহরে দেখা বৃষের মতো এক অতিকায় প্রাণী তার চলে যাওয়া পথের ধারে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সিং ঘষে এক সুঠাম বৃক্ষের কাণ্ডে। সন্ধ্যে নামার আগে নেহাৎ পথ হারিয়েই এই প্রান্তে এসে পড়ে গবাদি পশু। অথচ এই দানবকে দেখে বেচারাও মনে হয় না। যেন এই মাত্র বুজরুকের বিদ্রূপ থেকেই জন্ম নিয়েছে সে। বুজরুক চলে গেল... এ দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়ে যাবে, যতক্ষণ না আমি এখান থেকে যাই। খোদার মোজেজা!
এমতাবস্থায় একাকীত্ব মাঝে হঠাৎই একপ্রকার হতাশাজাত জেদ প্রকট হয়। অনর্থক, অথচ শক্তিক্ষয়ী বিপর্যয়ের মতো। কার রাগ কোথায় গিয়ে পড়ে... আদৌ রাগ, না অন্য কোনো অনুভূতি আড়াল করতেই এই 'রাগ'-এর আস্তারণ... এসব ভাবতে ভাবতেই চারপাশের সব কিছু বদলে একটা শিশমহলের মাঝে এসে পড়ি। বহু-পরিচিত কোনো সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের মতো-- একের পর এক আয়নার ল্যাবারিন্থে নিজের প্রতিবিম্বদের মাঝে আসল নিজেকেই হারিয়ে ফেলি। মনে হয় কোনো আততায়ী এখনই এসে পড়বে, আমার হাতে কোনো প্রতিআক্রমণের অস্ত্রও নেই। কে আততায়ী!... মনে হয় এই প্রতিবিম্বদের মাঝেই কেউ। কোনো এক সত্তা এত দিন ধরে যা করতে চাইছে— অবশেষে করেই নেবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণ।
কোনো স্বৈরিণীকে উদ্দেশ্য করে যথেষ্ট ক্ষোভ, উষ্মা, অভিমান প্রকাশ করার পর মনে হয় এক পদাঘাতে এই বল্মীক স্তর ভাঙি। তারপর আমারও আর এখানে থাকার নেই। বামহস্তের বাহুমূল থেকে তর্জনীর প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুৎতরঙ্গের ন্যায় এক যন্ত্রণা অনুভূত হয়। বাম চক্ষু রক্তাভ হয়, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি গাছের গায়ে ভর দিয়ে। এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি শ্বেত বলয়ের দিকে। শিশমহলের দর্পনে দর্পনে তাঁর প্রতিবিম্ব। এক সময়ে জ্যোৎস্নালোকে মনে হয়-- দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, নিজেই চাইছেন আহত হতে। অন্তর্যামী যোগিনী... কে পারে আর কে পারে না, কী পারে আর কতটা পারে- তাঁর কি কিছুই অজ্ঞাত আছে?
ধুলো ঝড়ে উড়ে যায় চরাচর। সে প্রবল আঁধিতে তাঁর অট্টহাস্য শুনতে পাই, আর সেই দৈত্যাকায় বৃষ এসে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে চলে যায় শিশমহল।
কানের কাছে অস্ফুটে শুনতে পাই, কানের কাছে স্পষ্ট শুনতে পাই- কোথায় ডুবে যাচ্ছ দিব্যসিংহ? কোথায় ডুবে যাচ্ছ?
দেহলিজেই ধীরে ধীরে বসে পড়ি আমি। দ্রষ্টা ভাববে নতজানু... আসলে, প্রকৃত অর্থে নিঃস্ব হলে এমনই লাগে।
রাতে সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি পরে শুই। পানের অবশেষ কণিকা গলায় চলে গেলে কাসতে কাসতে তন্দ্রা কেটে যায়। হাতের নাগালে রাখতে হয় জলের পাত্র।
অর্ধতন্দ্রায় দেখি—
বৃষ্টি ভেজা মাটিতে পায়ের ছাপ।
সেই শ্রী-চিহ্নেও ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়ছে।
আর একটা একটা শ্বেত পদ্ম ফুটো উঠছে।
চোখ খুলে দেখি আলো ফুটে গেছে।
মাথা তুলতে পারি না।
মনে হয়,
এক কিশোর সারা রাত জেগে দেউলের
আলো ফুটলে প্রাঙ্গন পরিষ্কার করে রাখা
সকাল হলে জনপদ ব্যস্ত হয়ে উঠবে, অথচ
শুয়ে শুয়ে ভাবছে, এই পদচিহ্ন মন্দিরের দিকে
ভাবছে 'অনুসরণ করে দেখি একবার'। কিন্তু মাথাই
তুলতে পারছে না...
কানের কাছে অস্ফুটে শুনতে পাই, কানের কাছে
Comments