ছোট গল্প— অতনু টিকাইৎ
ওম শান্তি
ঠোঁটের বাম কোণ বেয়ে লালাটা ক্রমাগত গড়িয়ে কানের তলা হয়ে বালিশে এসে মিশছে। আর তাতেই কানের তলাতে একটা সুড়সুড়ি অনুভব হচ্ছে যেন। অনেক সময় ধরেই ঘটনাটা ঘটে চলেছে।
নেহারিদেবী হাতটাকে উঠিয়ে নিয়ে এসে সেখানে ঘষা দিতে চাইলেন কিন্তু হাতটাকে তিনি এক চুলও নড়াতে পারলেন না। তারপর জিভটা বের করে বহমান লালাটাকে চেটে তার গতিপথটাকে বন্ধ করার চেষ্টা করলেন কিন্তু সেটিও করে উঠতে পারলেন না তিনি। অথচ অবাক হলেন না। আজকাল এমনটাই ঘটছে। নার্ভগুলো যেন একসঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে কখনো কখনো। আবার কখনো মন মতো সাড়া দিচ্ছে। রাতের বেলায় সাধারণত এমনটা ঘটে থাকে। শরীরে শক্তি বলতে থাকে না। দুই ঘন্টা আগে শরীরটাকে একপাশ করে শুতে চাইছিলেন তিনি। পারেননি।
একইরকম ভাবে দিনের পর দিন পিঠের ভরে শুয়ে থাকার কারণে পিঠের চামড়াটায় জ্বালা ধরে গেছে। কিছু সময় তো মনেহয় যেন পিঠের চামড়াটাই আস্ত নেই আর। এই ঘরটায় একটা ঘড়িও নেই। তবে খাটের সরাসরি দেওয়ালটার ওপর একটা ভেন্টিলেটর আছে। তা দিয়েই বাইরের অন্ধকারের মাত্রা পরিমাপ করা যায়। এই যেমন এখন বাইরে অল্প অল্প আলো দেখা যাচ্ছে। ভোর হবে হবে। নেহারিদেবী অনেক সময় ধরেই সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন কখন সকাল হবে। ঘরের মানুষগুলো উঠবে একেক করে।
দিন হলে জানালাটা খোলা থাকে। তা দিয়ে হাওয়া আসে। কাছে দূরে থাকা মানুষগুলোর কথা আসে। কথায় ভর করে স্বপ্ন আসে। তুলনায় খানিক ভালো লাগে নেহারিদেবীর। কিন্তু এই রাতটা বড্ড বেশি কষ্ট দেয় তাকে। যেন শেষ হতেই চায় না। যেন কেউ কোত্থাও নেই।
আর থাকলেও যেন ডাকার দিন ফুরিয়ে এসেছে। সাহসে কুলোয় না। দিনের বেলাতেও না। এখন সময় কেবল অপেক্ষা করার। আর কিছুই পরিবর্তন হওয়ার নেই। আচ্ছা মানুষ যখন বুঝে ফেলে, তার অবস্থার আর কিছুই পরিবর্তন হওয়ার নয়; মানুষটার মন কি তখনই মরে যায়? নাকি আরো কিছু দিন, মাস, বছর পরে? ধীরে ধীরে? তারপর শরীরের মৃত্যুর অপেক্ষা করে শুধু। শরীরের আগে মন মরে গেলে নাকি সেইসব মানুষ মরার পর আর আসে না। ভুল করেও না।
নেহারিদেবী অপেক্ষা করছেন, আজ কেউ তাকে দেখতে আসে যদি। শেষের এই দিনগুলোতে সবাইকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে। বন্ধু শত্রুর মধ্যে আর কোনো ভেদাভেদ চোখে পড়ে না। মনে হয় কেউ এসে পাশে বসুক। অনেক অনেক কথা বলুক। বাসুর ঘুম ভাঙলো? এসে মুখে রাতভর জমাট বাঁধা পলি কাপড় ঢুকিয়ে মুছে দেবে বাসু। এক পাশ ঘুরিয়ে পিঠটায় পাউডার লাগিয়ে দেবে। গা হাত পা মুছিয়ে ফ্যানটা চালিয়ে দিলে অল্প একটু আরাম লাগে শরীরটায়। প্যাডে পায়খানা জমতে জমতে শুকনো খড়খড়ে হয়ে গেছে।অফিসের তাড়ায় আজ সকালে কি সময় হবে তার? অনেকবার ইচ্ছা করেছে ছেলেকে বলতে, খাটটাকে টেনে জানালাটার একটু কাছে ঘেঁসে রেখে দেওয়া গেলে দেখনা? কিন্তু সাহস হয় না। সাহস হয় না বলতে, রাতে ঘুমের ওষুধ আরেকটা বেশি করে দিস বাবা। যা দিস তা'তে একটু পরেই ঘুম ভেঙে যায়। তেষ্টা পায় খালি। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে কিছু বলারই আর সাহস হয় না নেহারিদেবীর। আর তারইবা দোষ কোথায়! অফিস সামলে মায়ের যাবতীয় দেখাশোনা তো তাকেই করতে হয়। ছেলের বৌ এর দায়িত্ব বলতে, দুপুরে একবার খেতে দেওয়া। কথা হয় না দুজনের তেমন। খাইয়ে দেওয়ার সময়ও না। তার খাওয়ানো দেখে মনেহয় সব ভাত তরকারি এক মুঠোয় করে হা করা মুখটায় গুঁজে দিলে যেন সুবিধা হতো। নেহারিদেবী মাথা নীচু করে থাকেন।
এই ঘরটা অপ্রয়োজনে তেমন খোলা হয় না। খুলে রাখলে সারা ঘরময় প্রস্রাব পায়খানার দুর্গন্ধে ভরে যায়। তাই ঘরের জানালা দুটোই সারাদিনভর খোলা থাকে। একমাত্র রাতে চোর-ডাকাতের ভয়ে বন্ধ করে দিতে হয়। সারা রাত দরজা-জানালা বন্ধ থাকার কারণে সকালে ঘরের দরজাটা প্রথম খুলতেই একটা তীব্র দুর্গন্ধ যুক্ত গরম গ্যাসে স্নান হয়ে যাওয়া হয়। দরজা খুলেই নাকে রুমাল ঢেকে তাই চটজলদি জানালা দুটো খুলে দেয় বাসু। ছেলের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে লজ্জায় সেই সময়টা নেহারিদেবী কুঁকড়ে যান।
২.
সময় থম মেরে গেছে আর নেহারিদেবী হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকেছেন, এমন ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটেনি। ছুটতে ছুটতেই কিভাবে যেন পার হয়ে গেছে জীবনের এতগুলো বছর। অথচ ভাবলে মনেহয় এইতো সেদিন বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে আসা হলো তার। এখন ভূতের মতো একা বিছানাটায় পড়ে থেকে ফেলে আসা অতীতের ভালো মন্দ কত ঘটনাই চোখের সামনে ভীড় করে আসে।
শৈশবে স্কুলশিক্ষা না জুটলেও নেহারির আত্মসম্মানবোধ ছিল তীব্র। স্বল্প ভাষী, ধবধবে ফর্সা, সুন্দর মুখশ্রী নেহারির নয় বছরের মাথায় বিবাহের কথা পাকা হয়। বাল্যবিবাহ তখন দেশে চালু ছিল। ছেলে ভালো। লম্বা। উচ্চশিক্ষিত। স্কুল মাষ্টার। নিজেদের বেশ কিছু জমিজমাও আছে। গাঁয়ে খাতির ভালো। তবে দুশ্চিন্তা একটাই, বড় বেশি দূরের গাঁ। চাইলেই হেঁটে গিয়ে মেয়েকে একবার দেখে আসা যাবে না। তবে তা তেমন বড় সমস্যা কিছু নয়। রোজ রোজ কি আর যাওয়া আসা হবে নাকি! দশে মাসে একদিন কারোর সাইকেল চেয়ে মেয়ে দেখতে যাওয়া যাবে তখন!
বিয়েটা হলো। যদিও দ্বিরাগমন হলো তিন বছর পরে নেহারির বারো বছর বয়স যখন। শ্বশুরবাড়িতে নতুন বউ এর মুখ দেখতে এসে কয়েকজন দিদা বয়সী বুড়ি সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, আমাদের আদিত্য বাবাজীবন তো লাল টুকটুকে সাহেবী বউ নিয়ে এসেছে। এই বউ গোহাল ঘর পরিস্কার, ক্ষেত খামার, গরু বাছুরের যত্নাত্তির ধাক্কায় টিকলে হয়!
সেই বুড়ি দিদারের কথাটাই যেন সত্য হলো। গরু বাছুর, গোহালঘর, ক্ষেত খামার সবকিছু সামলাতে পেরেও ছয় বছরের বেশি শ্বশুরঘর করা হলো না নেহারির। কর্কট রোগ সারাতে কলকাতা গিয়ে আর ফেরা হলো না আদিত্যর। সতেরো বছর বয়সে স্বামী হারা হলো মেয়েটা। প্রথম সন্তান শীতলার বয়স আড়াই বছর তখন। বাসু পেটে। সন্তান হারিয়ে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি শোকে পাথর। অবশ্য ঘরের একমাত্র রোজগেরে চলে যাওয়ায় অভাবের তাড়নায় ঘরে অল্প কিছুদিনেই শোক ফুরিয়ে এলো। দৈনিন্দিন কাজে ফিরলো সকলেই কিন্তু সদ্য স্বামী হারা পোয়াতি নেহারির মাথায় কেউ হাত রেখে একটিবারের জন্য বললো না, চিন্তা করিস না মা, আমরা তো আছি।
এমনকি যেদিন পাকাপাকিভাবে বাপের বাড়িতে গিয়ে ওঠার কথা জানালো নতুন বউ, সেদিনও সেভাবে কারোর বাধা পেলো না সে। শ্বাশুড়িমা'কে প্রণাম করতেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে থাকলেন।
যদিও বাপেরবাড়িতে মিশে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি নেহারিকে। বাসুর জন্ম সেখানেই। শীতলা আর বাসুর সাথে তাদের ছোটো মামার বয়সের ফারাক খুব বেশি নয়। চার ভাই'ই তখন স্কুলে পড়ে। চার ভাইকে খাইয়ে স্কুল পাঠানো। সন্ধায় টিউশন মাষ্টারের বাড়িতে ল্যাম্প হাতে পৌঁছে দেওয়া। নিয়ে আসা। এতগুলো ছেলেমেয়েকে চোখে চোখে রেখে সময় পেরিয়ে যেতে লাগলো নেহারির। মামাদের কোলে বড় হতে থাকলো শীতলা আর বাসুও।
মেয়েটা যাতে কখনো নিজেকে একা খুঁজে না পায়, হয়তো সেকারণেই, একদিন মা ঘরকন্নার চাবির গোছাটি নিজের কাপড়ের খুঁট থেকে খুলে নেহারির শাড়ির খুঁটে বেঁধে দিলেন।
৩.
এই তিন কুড়ি পাঁচ বছর বয়সে এসে ভাবতে বসলে নেহারিদেবীর জীবনে হারিয়ে ফেলার তালিকা দীর্ঘ। সতেরো বছর বয়সে স্বামীকে, তিরিশ বছর বয়সে বাবা, পঞ্চাশ বছর বয়সে মা চলে গেলেন। ভাইদের কবে হারালেন? কত বছর বয়সে? বলা কঠিন। মায়ের চলে যাওয়ার পর চাবির গোছা আর তার কাছে থাকুক, কোনো ভাই এর বউই চাইছিলো না। মায়ের চলে যাওয়ার আগেও অনেক রকমের কথা কানে আসলেও নেহারিদেবী আমল দিতেন না। মায়ের দেখানো পথেই চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই চুপ থাকাটিকেও একসময় ভাইরাও চালাকি করছি ভাবলে আর দেরি করেননি নেহারিদেবী। চাবির গোছাটি বড় ভাই এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই রাতে উঠোনেই খাট বিছিয়ে শুয়ে থাকলেন। রাতে উঠোনেই খাবারের থালা এনে দিলো ছোটো ভাই এর বউ। বারান্দায় শোওয়ার জায়গা হয়েছে জানালো। বালিশ কাঁথা খাট যা ভাগে পড়েছে, ওখানেই রাখা আছে।
এতকিছু হারানোর পরেও নেহারিদেবীর নিশ্চিন্তি বলতে, বাবা বেঁচে থাকতেই মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেছেন। ছেলের পোষ্টমাষ্টারির একটা চাকরি হয়েছে। যদিও অনেক দূরের গাঁ। সেখানেই বৌ বাচ্চা নিয়ে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকে। দুই তিন মাস পরপর একবার দেখা করতে আসে। নেহারিদেবীও ছেলের কাছে যেতেন বাড়িতে পূজাপাব্বনে পিঠে ইত্যাদি হলে তা পৌঁছাতে।
ঠিকঠাকই চলছিল সব। সেদিন কেমন করে যে পা টা দিতেই... বৃষ্টি পড়েছিল। পুকুরপাড়ের সিড়িটায় পলি জমেছিল। পিছলে কোমরের ভরে পড়তেই মেরুদন্ডের হাড়টি ভেঙ্গে যায়। তড়িঘড়ি কাছের তমলুক সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার সব দেখে শুনে কলকাতা রেফার করেন। কলকাতায় ষাট হাজার খরচে অপারেশন হলে ছয় মাসের বেড রেস্ট লিখে দেন ডাক্তার। প্রস্রাবের জন্য ক্যাথিটার গুঁজে সাতদিন পর ছুটি পেলে সকলের প্রস্তাব মতো বাসুর ভাড়াবাড়িতেই বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়।
অপারেশনের টাকা জোগাড়ে এমনিতেই বাসুর ঘটিবাটি বিক্রির মতো অবস্থা। তার ওপর ছোটো দুই কামরার ভাড়া ঘরে এক কামরা শ্বাশুড়িমায়ের জন্য ছাড়তে হবে শুনে বাসুর বউ এর তো সংসারের পাট চুকিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাই যাই। প্রায় প্রতিদিন কিচিরমিচির লেগেই থাকতো। নেহারিদেবী টের পেতেন। নেহারিদেবীর ভাইয়েরাও টের পেতেন নিশ্চয়ই। তাই আর একটি বারের জন্য দিদিকে দেখতে আসেনি। দেখতে এলেই পাছে বাসু এইটুকু ঘরে এতগুলো মানুষের থাকার অসুবিধার কথা উঠিয়ে দিদিকে তাদের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেয়।
এই এক রকম মৃতপ্রায় জীবনে দুটো কথা বলার মানুষ বলতে বাসুর প্রতিবেশী বন্ধুর মা। ওনারও বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। স্বামী গত হয়েছেন এক দশক আগে। এক ছেলে। দেশের ঘর, মাঠ, পথঘাট, মস্ত বড় উঠোন, তুলসীতলা ছেড়ে এখন ছেলের ছেলের কাছে থাকেন। ওনারও কথা বলার মানুষ নেই নয়তো কেনইবা এই দুর্গন্ধের ঘরটায় যেচে বসতে আসবেন। এসে বসে যে গল্পই করেন, তা নয়। চুপ করে বসে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। প্রায় সময়ই নেহারিদেবী কথা বলার অবস্থায় থাকেন না। একাত্মতা অনুভব করতে পারেন বোধহয়। একদিন দীর্ঘশ্বাস গিলে বললেন, ভগবান আমাদের কথা বলতে দিলে না। যখন বউ হয়ে শ্বশুরবাড়ি এলাম তখনো দিলে না। শ্বাশুড়ির কথা মতো উঠতাম বসতাম। আর এখন যখন শ্বাশুড়ি হলাম তখন বউমাদের কথা মতো...
নেহারিদেবী কিছু বলেন না। নেহারিদেবী ওনার সব কথা শুনেই তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা শান্ত হাসি রাখেন।
সারাটা জীবন আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচা মানুষটা একবার ভেবেছিলেন ছেলে বাসুকে ডেকে বলবে, তাকে বাপের বাড়িতেই পৌঁছে দিয়ে আসতে। নিজের কারণে ছেলের সংসারের অশান্তি কোন্ মা চায়! তারপর ভাই এর বউদের মুখগুলো মনে পড়তে আর সাহস হয়নি বলার। ভাইদের ক্ষমতা নেই বউদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে দিদির দায়িত্ব নেবে। তারচেয়ে উঠে না দাঁড়ানো পর্যন্ত এখানেই থাকা ভালো। যতই হোক, নিজের ছেলের ঘর। অধিকার এখানেই মানায়। বাসু আজকাল বিরক্ত একটু থাকে ঠিকই তবে তার দায়িত্ববোধ নিয়ে নেহারিদেবীর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাছাড়া পোষ্টমাষ্টারি করে কতই আর পায়। নেহারিদেবী জানেন অপারেশনের খবরে ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে কুড়ি হাজার টাকা বাসুর হাতে ধরিয়েছিল। বাকিটা তো বাসুই...। বাসুর মতো ছেলে হয় না।
Comments