তনিমা হাজরা'র দুটি দীর্ঘ কবিতা

 


০১|| ঠিক কতটা বাঙালি আছি 

ঠিক কতটা বাঙালি আছি 

বাংরেজিন্দি ভাষণে, 

কতটা বাঙালি আছি 

উত্তরসূরীদের ভাষা নির্বাচনে, 

কতটা বাঙালি আছি 

চেবানো ও জড়ানো বাংলা ফলানো আবৃত্তিতে, 

কতটা বাঙালি আছি ফিউসনে গুলে খাওয়া লালন গীতিতে,  


আচ্ছা বলতে পারো নিজেরই বুকে হাত দিয়ে, ঠিক কতটা বাঙালিত্ব বাঁচিয়ে আর কতদিন থাকতে পারা যায় বিশ্বায়নের এই প্রবল উল্কা গতিতে।। 


কতটা বাঙালি আছি খাদ্যাভ্যাসে, 

কতটা বাঙালি আছি জীবিকার তাগিদে ছুটে ছুটে মরে এদেশে ওদেশে, 

কতটা বাঙালি আছি চর্বিত চর্বন করে সেই রবি আর নজরুলে, 

কতটা বাঙালি আছি রোজকার অনায়াস বেশবাসে ধুতি শাড়ি শিকেয় তুলে, 

কতটা বাঙালি আছি নিয়মিত পড়া শোনা গানে বা সাহিত্যে,  

কতটা বাঙালি আছি ঠিক বলতো বাঙলাকে উত্তরসূরীদের অনুভবে আর অক্ষরে চারিয়ে দেবার 

সঠিক দায়িত্বে।


আচ্ছা বলতে পারো, নিজেরই বুকে হাত দিয়ে, ঠিক কতটা বাঙালিত্ব বাঁচিয়ে আর কতদিন থাকতে পারা যায় বিশ্বায়নের এই প্রবল উল্কা গতিতে।।


কতটা বাঙালিয়ানা কেটে কুটে ছেঁটে ফেলে দিই প্রবাসে অভিযোজনের বাস্তবিক তাগিদে, 

কতটা নির্ভেজাল বাঙালি হয়ে থাকতে পারবো আর কতদিন 

নিয়ত নিজেরই অন্তরে সিঁদ কাটা অনিচ্ছুক রসিদে, 

কতটা বাঙালিপনায় ভিজে জবজবে হতে চাইলে লোকে বলবে, ওহে তুমি তো ভারি গোঁড়া, 

কতটা জেদি বাঙালিত্ব চেপে ধরে বসে থাকতে থাকতে বুঝে যাবো একদিন, অন্তর্জালের অবশ্যম্ভাবী জাঁতাকলে একছাঁদে গড়া এই বদলের পৃথিবীতে আমার ঠ্যাংদুটো এগোবার শর্ত নামঞ্জুরে একদম খোঁড়া। 


আচ্ছা বলতে পারো নিজেরই বুকে হাত দিয়ে, ঠিক কতটা বাঙালিত্ব বাঁচিয়ে আর কতদিন থাকতে পারা যায় বিশ্বায়নের এই প্রবল উল্কা গতিতে।। 


কতটা বাঙালি হলে বাঙালির সাথে বাঙালিও হিন্দি বা ইংরেজিতে কথা বলে জাহিরের চালে, 

কতটা বাঙালি হলে মেকি বাঙালিপনাকে মাখে স্নো বা পাউডার করে মুখে আর গালে,  

কতটা বাঙালি হলে বাঙলায় হাবুডুবু খেয়ে তবু ভাবি এইটাই তো প্রার্থিতসুখ, 

 কতটা বাঙালি হলে নির্ভেজাল বাঙালি হয়ে বাঁচাটাই তোমার ওষুধ না খেয়ে জিইয়ে রাখা ক্রনিক অসুখ।।

 

 

আচ্ছা বলতে পারো নিজেরই বুকে হাত দিয়ে, ঠিক কতটা বাঙালিত্ব বাঁচিয়ে আর কতদিন থাকতে পারা যায় বিশ্বায়নের এই প্রবল উল্কা গতিতে।। 

 

কতটা বাঙালি ছিলাম সত্যি সত্যিই সুদূর অতীতে, 

কতটা বাঙালিয়ানার থেকে এখন প্রতিদিন দূরে চলে যাচ্ছি দুর্বার গতিতে, 

কতটা বাঙালি থাকতে চাইছি আমি দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণ, 

অথবা কতটা বাঙালিত্ব হারানোই আমার অভিব্যক্তির প্রত্যহ সাধন,  


আচ্ছা বলতে পারো নিজেরই বুকে হাত ঠিক কতটা বাঙালিত্ব বাঁচিয়ে আর থাকতে পারা যায় বিশ্বায়নের এই প্রবল উল্কা গতিতে।।


কতটা বাঙালি হলে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যভাষা বাংলায় অনুপ্রবেশ করে

নির্বিচারে, 

কতটা বাঙালি হলে বাঙালিই চিরকাল বাঙালির পা ধরে টানে, নিরঙ্কুশ দোষ চাপায় বাঙালির ঘাড়ে, 

কতটা বাঙালি হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বাঙালি বাঙলার ভিটেমাটি ছেড়ে, 

কতটা বাঙালি হলে বাঙলার বাইরে বাঙালি বাঙালির হাত ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্ত করে ধরে।।


কতটা বাঙালি আছি জাপানি জামাই আর তামিল পুত্রবধূ নিয়ে, 

কতটা বাঙালি আছি ভালবাসার ধারাস্রোতে উত্তরসূরীদের সঙ্করজন্মস্নেহ দিয়ে।।


আচ্ছা বলতে পারো নিজেরই বুকে হাত দিয়ে, ঠিক কতটা বাঙালিত্ব বাঁচিয়ে আর কতদিন থাকতে পারা যায় বিশ্বায়নের এই প্রবল উল্কা গতিতে।। 


কতটা বাঙালি হলে বাংলার ধ্বংস দেখেও এখনো চুপ করে বসে আছি ঠুঁটো জগন্নাথ, 

কতটা বাঙালি হলে অনুদান অপমান সয়ে সয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হও তুমি ফেলে রেখে ঘেন্নার ভাত।। 


কতটা বাঙালি হতে গিয়ে তুমি আস্তে আস্তে ক্রমশঃ যাচ্ছো ক্ষয়ে, 

কতটা বাঙালির ভেক ধরে থেকে নিজেই বুঝেছ গোপনে, 

 পদবিটুকুন ছাড়া তুমি আর কোত্থাও একফোঁটা বাঙালি হয়ে 

  বেঁচে নেই, 

অহেতুক বাঙালিপনার মরিচিকায় দূরে আরও দূরে সরে যাচ্ছে তোমার মনুষ্যত্বের খেই।। 


সাতকোটি থেকে বেড়ে

  আঠাশ কোটি, 

হায়, হে মুগ্ধ জননী, 

 এখনো রেখেছো সেই বাঙালি করেই 

আজও তো কই মানুষ করনি।। 


০২|| অরুণাংশুর_সাথে_বার্তালাপ

তোমার সেই কাকা কি "চাইল্ড অ্যাবিউজ"শব্দটা জানতেন অরুণাংশু, 

যিনি বাচ্চাদের দিয়ে নিজের পা টেপাতেন, মালিশ করাতেন?

কিংবা,

 আমার সেই পিসিমার ভাসুর পো

যিনি ছোট মেয়েদের ইজের খুলে দেখতেন আর হাত লাগাতেন তাদের গোপন স্থানে তাদের একটু নিরালায় পেলেই।

গোলগাল গালের বাচ্চা দেখলেই প্রচন্ড জোরে গাল টিপে দেওয়া স্বভাব ছিল আমাদের সরমা কাকীমার। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম আমি একদিন সেই আদরে। 


 আমাদের মফঃস্বল শহরের সেই সব পাড়াতুতো দিদিরা কি "প্রাইভেসি"শব্দটার মানে জানত,

   যারা অন্যের প্রেমপত্র ছিনিয়ে নিয়ে পড়ে

 হেসে কুটিপাটি হত, 

অথবা, 

ও' পাড়ার সেই অনাদিকাকু, যাঁর প্রিয়তম নেশাই ছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের প্যান্ট টেনে খুলে দিয়ে তাদের কাঁদিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসা।


এদের কারুর কোনোদিন একফোঁটা শাস্তি হয়নি অরুণাংশু, 

প্রতিটি বিজয়ায় আমাদের অভিভাবকদের নির্দেশে এদের আমরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি। 

আর নাড়ু,নিমকি খেয়ে নীরব থেকেছি।। 


শীতকালে আমাদের বাগানের কোণে ঝরাপাতা ঝাঁটপাট দিয়ে ডাঁই করে পুড়িয়ে দিতো আমাদের কাজের মেয়ে পার্বতীদিদি। 


এত বছর ধরে এত পাতা পুড়ে গেল, তবু্ও আমার মনের ভেতর ডাঁই করে রাখা এসব পাতাগুলো এখনো কেন পোড়েনি অরুণাংশু, 

এখনো বুকের মধ্যে পেত্নীলাগা ঘূর্ণির মতো গোলগোল গোলগোল হয়ে ঘোরে ফাল্গুনের পাগলা হাওয়ায়।







Comments

আরও পড়ুন

তৃতীয়— মাস-সংক্রান্ত

২৩ | ফেব্রুয়ারি সংখ্যা | ২০২৫

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৩

রঙ্গন রায়

কবিতা গুচ্ছ

জুজুতন্ত্রের সমূহ শ্বাপদ এবং হুজ্জতি

সিনেমা-বিষয়ক নিবন্ধ -- জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

একটি কবিতা সিরিজ —

সৌমিক মৈত্র

মনোজ চৌধুরী