বীথিকা ধরে হেঁটেছে দীন


 (ক)

প্রত্যেকের বুকের পাশে একটা টলটলে কালো দিঘী থাকে। যে দিঘীগুলো বর্ষায় সাদা শালুকে ভরে ওঠে। কালো জলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে গোটা শরীরে যেভাবে সাজের কাজল ছড়িয়ে পড়ে চোখের তলা জুড়ে। তারপর সমস্ত শরীরের মাংসপিণ্ডকে পাঁজা কোলা করে তুলে নেয়, সহসা রেখে আসে পাপড়িদের কাছে। ভুলগুলো বেছে বেছে তুলে নেয়, খুদকুঁড়োর মতো ছুঁড়ে ফেলে দেয় জলেদের গানে। যে গানগুলো বাজে, খারাপ, ডানা ভেঙে যাওয়া মথেদের মতো অদরকারী। তাদের পাশ কাটিয়ে সবাই মেতে ওঠে শালুকের রঙ্গে, কালো রঙ সরে যাওয়ার মহোৎসবে। কালো রঙ সরে যায়, টগবগ করে উঠে আসে সাদা শালুকের প্রজন্ম। সবুজ জলের কল্লোলে প্রজন্মরা হেসে ওঠে, ধুপকাঠি জ্বালায়, মোচ্ছব বসায়, তারপর হইহই করে জড়ো হয় সাদা শালুকদের গোড়ায়। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ওরা। ওদেরও শেখানো হবে সব অপমান মুখ বুজে শুষে নিতে হয়, সব কান্না বৃষ্টিতে আড়াল করে নিতে হয়, সব মন খারাপ সুখী ঘরের কোণে একপাশে চাপা দিয়ে রেখে দিতে হয়, সব বিষন্নতা ভুলে যেতে হয়, দুঃখগুলোর কোনো নাম দিতে নেই। ওরা শিখবে সুখী হতে— কালো জলের উপর দাঁড়িয়ে কিভাবে কালো জলকে সুনিপুণভাবে আড়াল করা যায়। সুখী মাংসপিন্ডের দল শালুকদের গায়ে এঁকে দেয় কোনো এক প্রেমিকার ওড়নার নকশা। শালুকদের এক একটা সাদা পাপড়ি চুপিসারে হয়ে ওঠে হলুদ। তারপর একে একে ফুটে ওঠে গোপন তিল, ঘেঁটে যাওয়া চোখের কাজল, চুমুর ক্ষত। ধীরে ধীরে চারপাশে একটা মিষ্টি গন্ধ ভুলিয়ে দেয় কালো জলের কটু গন্ধ। একটা গুনগুন সুর ভুলিয়ে দেয় কান্নার শব্দ। যারা খুব সহজে ভেসে যেতে পারতো হেসেখেলে। তারা হয়ে ওঠে একসময় প্রেমিকা। যে প্রেমিকা ভালোবাসে ফুলেদের শহর, ন্যাপথলিন গন্ধ সোয়েটার, ও কবিতার ছন্দ। যার প্রেমিক হারিয়েছে ‘ভালবাসি’ টুকু না শুনেই। তবু সে শালুকের পাপড়িদের মতো থাকে থাকে যত্নে গুছিয়ে রাখে তার ওড়নায় লেগে থাকা প্রেমিকের কান্নার রঙ, ভালবাসি শুনতে চাওয়ার আকুলতা, আচমকা চুমুর ছোঁয়া। ক্রমে দূরত্ব ফিকে হয়। হলুদ শালুকের সাদা রঙ ভেসে চলে যায় কালো জলে ভুলগুলোকে সাথে নিয়ে। পড়ে থাকে শালুকের প্রজন্ম, হলুদ রঙ, সুখী প্রেম, প্রেমিকা ও তার ওড়না, গুনগুন করে গেয়ে চলা অজানা কোনো শব্দ, আর কিছু তুলে রাখা ভালোবাসার শব্দ। শালুকগুলো শুধু হতে চায় প্রেমিকা, যার গায়ে লেগে থাকবে হলুদ জোছনা, ফুলেদের গন্ধ আর না বলা ‘ভালবাসি’ টুকু। তবু তারা একবারও চাইলনা সাদা শালুকের জীবন, কালো জলে ভেসে থাকার জীবন; যে কালো, বিদঘুটে জলটা আজীবন তাদের ভার নিয়ে চললো। 

Click now
(খ)
প্রত্যেকে প্রেমিক। যারা প্রেমিক নয় তারা হয় প্রেম সয় নয়তো প্রেমকে ফেলে ধীরে ধীরে ঢুকে যেতে চায় মৃত্যুর ভিতর। তারপর খুঁজে ফেরে মুঠো মুঠো জোনাকি, পাহাড়ি শীতলতা, নোনতা ঢেউ কিংবা প্রেমিকার গায়ের গন্ধ। কিচ্ছু না পেয়ে, আফসোস করে ফিরে আসে একটা রোদমাখা ভোরের কাছে, যে ভোরে বেজে ওঠে পুরোনো মৌন হৃদয়ের সাদাকালো সুর— “ওঁং নমঃ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং...”। তারপর সে ভুলে যেতে থাকে আগের রাত, ঘুম না আসা রাত। সেই গানের গলা প্রেমিকের কাছে চেনা মনে হয়। সে মনে করতে করতে ডুবে যায় সূর্যের প্রথম আলোয়, ডুবে যেতে থাকে পুরোনো কোনো মাতাল করা গন্ধে। যে গন্ধ একনাগাড়ে পূরণ করে দেয় কত কত রাতের ঘুম। যে গন্ধ চাপা কান্নায় ব্যথা জমে থাকা গলায় হাত বুলিয়ে নিয়ে নেয় সব দলা পাকানো ব্যথা। একটা জীবনে যে শুধু ঘুরেই বেড়ালো; জীবন থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে জীবন, তার ভালো বাসার পাশে বেড়ে উঠলো একটা  নিম গাছ। হলুদ নিম ফলের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে বিষন্নতার দিনগুলি। এক একটা ফল গা ছুঁয়ে পড়ে পায়ের পাতার কাছে তারপর মিশে যেতে চায় শরীরে, রক্তে, মনখারাপে। তারপর তারা যেন একটু একটু করে গিলে নেয় সব আক্ষেপ। তারপর কাঁদতে কাঁদতে, ছটফট করতে করতে সে হেঁটে চলে বহুদূর। হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পায় নিম গাছের ছায়ার সুর। যে সুরটা হেমন্তের বাতাসের মতো ঢুকে পড়ে অনেক পুরোনো জামাটার বোতামের গা ঘেঁষে। যে বোতামটার উপর লেগে আছে একটা গন্ধ। সুরটা তারপর ছুঁয়ে নিতে চায় না বলা জমা কথাদের ঘর; হৃদয়। তারপর তারাও কেমন কেড়ে নিতে চায় সব মনখারাপ, শুধু রেখে দিতে চায় ভালোটুকু। অতঃপর সে ফিরে যায়। ফিরে যায় শান্ত শীতলতার কাছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভুলে যায় সব কষ্ট, চিনচিনে ব্যাথা। মনে পড়ে প্রেমিকার ফুলদানি, গা ভর্তি মিষ্টি গন্ধ, বন্ধুদের অ্যালবাম, প্রিয় উপন্যাস। এখানে খিদে নেই, দুঃখ নেই, কান্না নেই আছে শুধু তাপ্পি দেওয়া কয়েকটা দৃশ্য, যারা কুয়াশার মতো নিঝুম, শান্ত, স্বল্পস্থায়ী অথচ স্কুলের দিনগুলোর মতো সুন্দর। প্রেমিকের ক্ষত সারিয়ে দিয়ে তারা হয়ে ওঠে মহৌষধি, জোছনা, আর বরফ টুকরো। নিম ফল হয়ে ওঠে ঐশ্বরিক। আর নিমের শীতল ছায়ার সুর বেজে ওঠে তার কানে ঘুমপাড়ানি গান হয়ে। প্রেমিক নিম গাছের চরণ জড়িয়ে ধরে, জেগে ওঠে তার জাতিস্মর হওয়ার ইচ্ছা। এ জন্মের দুঃখভরা জীবন, যা তাকে জাতিস্মর হওয়ার ইচ্ছা জাগাল তাকেও সে একবার দু চোখ ভরে দেখলনা, দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলোনা। কাঙালের মতো পড়ে রইল ভালোবাসার জন্য। 

অলংকরণ —নম্রতা বালা

আকাশ ভর্তি আলো থেকে ঝরে পড়ে পরজন্ম টুপ টাপ শব্দে। জোনাকি পোকার আলোয় জ্বলে ওঠে জাতিস্মরের সংজ্ঞা। যারা ভাবে ভালোবাসা অপচয়, ভালোবাসা মায়া তাদের কাছে ভালোবাসা হয়ে ওঠে গীতবিতান। অশ্রুর দাগ মুছে গিয়ে হাতের রেখায় ফুটে ওঠে হলুদ জোনাকি। প্রেমিকার গোপন তিল থেকে ফুটে ওঠে একটা চিহ্ন— হলুদ শালুকের চিহ্ন। তারপর ভোর আসে, কেউ প্রেমিকের জানালার পাশে রেখে যায় একটা বৃদ্ধ নিমগাছ। ভেসে আসে পাকা নিম ফলের গন্ধ, বরফ টুকরো মিশ্রিত হাওয়ার সুর। প্রেমিকের মনে পড়েনা গত জন্ম। প্রেমিকা ভুলে যায় হলুদ শালুক। হলুদ রঙের মিল নিয়ে মেতে ওঠে গোটা পৃথিবী। উৎসব করে। হলুদ তো বিষণ্নতারও রঙ। আমরা দু হাত দিয়ে আঁকড়ে জাপটে রাখি অল্পবিস্তর ভালোবাসা। তারপর ভেবে ভেবে নাম দিই, ছবি আঁকি, অ্যালবাম বানাই, হাসতে হাসতে ছড়িয়ে দিই, বিলিয়ে দিই বিছানা বালিশে, কাপড়ে, বুকপকেটে, উঠোনে, দোরগোড়ায়, চায়ের দোকানে, মঞ্চে, কাগজে, টেলিভিশনে। গুছিয়ে গুছিয়ে তুলে রাখি আলনায় কিংবা আলমারিতে ন্যাপথলিন দিয়ে দিয়ে। সুটকেস ভরে ওঠে হাততালি, প্রশংসায়। আমরা ক্রমাগত ভুলে যাই অপমান, অশ্রু, দুঃখ, বুকের ব্যাথা, নিদ্রার অপচয়, মরতে চাওয়ার ইচ্ছা। আমরা ইচ্ছা করে সরিয়ে রাখি ভুল বোঝাবুঝি। বিষন্নতার পাশ কাটিয়ে চলে যাই, রেখে যাই বিষন্নতার ঋণ। আমরা ভুলে যাই দুঃখদের নাম দিতে, ভুলে যাই দুঃখদের নাম ধরে ডাকতে। ভালটুকু নিংড়ে নিয়ে বেদনাটুকু রেখে আসি ঘুমের ঘোরে, তেপান্তরের মাঠে। যাতে তারা হৃদয়ের এক একটা সিড়ি বেয়ে না নামতে পারে এই ভালো থাকার আড়ম্বরে, এই হলুদ রঙের রংমিলান্তিতে। তারপর, জোরে জোরে আওড়ে নিই— “হে প্রেম, আমাকে জাপটে রাখো, আগলে রাখো।” আমরা একমুঠো প্রেম বুকে ধরে রাখতে কত কী না সহ্য করে নিই! আমরা দুঃখগুলোকে হেলায় ফেলায় ফেলে আসি বাতিলের খাতায়।অথচ কী ভীষণ সত্য না; এই দুঃখগুলো বুকের পাথর, গলার ব্যথাকে শ্রাবণের বৃষ্টির মতো শরীর থেকে আলাদা করে নিয়ে যায় কোনো নাম না জানা দ্বীপে, এই দুঃখগুলোয় ভালোবাসাকে ভালবাসতে শেখায়!

Order now



Comments

দারুণ। লেখাগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়লাম...
Anonymous said…
So nice....
Anonymous said…
বাহ

আরও পড়ুন

সৌমাল্য গরাই

কবিতা সিরিজ

কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৪

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৮

একটি কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ২

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৬