অর্ঘ্য দীপ
এক গুচ্ছ অর্ঘ্য দীপ
বিষ
কখনও ভোররাত্রে জেগে উঠি৷ উঠে দেখি, ঘুম আসেনি তখনও। এমনই অলীক দ্বৈততার মধ্যে আমি পরপর কয়েকটি গান শুনি। বড় করুণ, বড়ই অন্তর্ভেদী সেই সুর৷ যে অপাপবিদ্ধ কিশোরের প্রথম প্রেমিকা মরে গেছে সর্পদংশনে, সুরের আবেশে তার সঙ্গে দেখা হয় আমার৷ আমরা দু'জনেই পুনরায় সুখী হতে চেয়ে অন্য অন্য মেয়েদের ভালোবাসতে চেষ্টা করি৷ বিলম্বিত ঘুমের ভিতরে এই জন্মের সব কামনা ফুল হয়ে ফোটে৷ সেই ফুলের আশ্চর্য সুবাসে জড়িয়ে থাকে একটি প্রাচীন শঙ্খচূড়৷
(২)
পরী
আমি একটিবার ছুঁয়ে দিলেই যে মেয়েটি
পরী হয়ে যেত
তাকে কোনও অন্য পুরুষ ছুঁয়েছে আজীবন
তাই আমার লেখা সব বিষণ্ণ কবিতার
চোখে জল,
দুই ডানায় প্রাচীন ক্ষতের দাগ
আর
আঙুলে অদ্ভুত রহস্যময়তা...
(৩)
হোরাসের তরবারি
মনখারাপ করে। মন, খারাপ করে। বুকের ভিতরে একটা নদী বয়ে চলেছে সেই কবে থেকে। কখনও কখনও তার কিনারায় খুব সন্ধে হয়ে আসে। কয়েকটা নাম না জানা পাখি উড়তে থাকে ইতস্তত...
এ আকাশ, সে আকাশ ঘুরে আমাদের পাশের বাড়ির বারান্দায় এসে জিরিয়ে নেয় খানিকক্ষণ। রাজকুমারী থেটি হারিয়ে গেছে, সে আর ফিরবে না কোনওদিন - পাখিগুলো যেন সেই খবরই জানিয়ে দিতে চায় । অন্য অন্য ছেলেদের দল, অন্য অন্য মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে চলে যায় অন্য অন্য দেশে। আমি পড়ে থাকি। যেখানে ছিলাম গত সপ্তাহে, গত মাসে, গত বছরে অথবা তার আগের বছরে... ঠিক সেখানেই। মনখারাপ করে। মন, খারাপ করে। তবুও ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে টিভি দেখি কী অপার মুগ্ধতায়!
দেখি, এই সবকিছু থেকে বেশ কিছুটা দূরে আলোর দেবতা হোরাস আর অন্ধকারের দেবতা সেথ নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে তো করছেই...
'মনে রেখো, হোরাসের তরবারি পাপাইরাসের সাহসের সমান শক্তিশালী...'
আমি খুব ভীতু। আমার দ্বারা আর কিস্যু হবে না।
(৪)
ইস্কুল বাড়ি
ইদানীং ঘুমের মধ্যে পুরোনো ইস্কুল বাড়িটা ঢুকে পড়ে প্রায়শই৷ অষ্টম শ্রেণি, 'খ' বিভাগ। একটা দুপুর কেমন যেন ভাসা-ভাসা, খোয়াবের মতো৷ ভাঙা কাঠের টুকরো দিয়ে বানিয়ে নেওয়া ক্রিকেট ব্যাট আর আইসক্রিম গাড়ি থেকে কেনা এক টাকা দামের পেপসির মতো৷ টিফিনের পরের পিরিয়ড যদিও চাপা উৎকণ্ঠার৷ অঙ্ক পরীক্ষার খাতাগুলো সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে এলেন জীবনকৃষ্ণ স্যার৷ আশানুরূপ নম্বর পাওয়া হল না এবারও৷ ইশ্, জানা অঙ্ক কেউ এভাবে ভুল করে আসে! হঠাৎই মনখারাপ করছে খুব৷ খারাপ মন নিয়েই শুরু হচ্ছে পরের পিরিয়ড৷ দুপুর গড়িয়ে ক্রমশ বিকেল হয়ে আসছে৷ ক্লাসঘরের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে অচেনা-অজানা মেয়েদের দল৷ সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলে সমস্ত মনখারাপ সেরে যায়। স্কুল-ফুরোনো মেয়েরা কেন যে এত সুন্দর হয়!
(৫)
সন্ধ্যাতারা
'তোমার দুঃখ কি তবে শেষ হয়েছে এখন?'
আশ্চর্য এক দিবাস্বপ্নের ভিতরে বালিকা জানতে চায় এই কথা। শুনে ঈষৎ অপ্রস্তুত হয় পথিক৷ খানিকক্ষণ সে চুপ করে থাকে৷ তারপর সামান্য হাসে৷ তাকিয়ে দেখে, একটি আলোকরশ্মি থেকে অন্য কোনও আলোকরশ্মির দিকে ভেসে যাচ্ছে কিছু মুগ্ধ ধূলিকণা৷ তেমনই কালের নিরন্তর প্রবাহে ভেসে যায় আজীবনের প্রতিটি অর্জিত দুঃখ এবং শোক৷ পথিকেরই বা থামলে চলবে কেন? সে এগিয়ে চলে সামনের দিকে৷ অবুঝের বেলা পড়ে আসে ক্রমশ৷ পথের দেবতার পথ যদিও ফুরোয় না কোনওদিন৷ স্বপ্নের সেই বালিকাটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে সন্ধ্যাতারার অপূর্ব আলোতে...
Comments