“ইয়ে আখরি শম্মেঁ ভি বুঝানে কে লিয়ে আ”

সোহম চক্রবর্তী

অলংকরণ-নম্রতা বালা




(১)


জ্বরের গায়ে বাদামী আলোয়ান। একটি লোক হেঁটে গেল হেমন্তের নিঝুম পাড়ায়, একা। ও আসলে রবীন্দ্রনাথের গান। কোন্ গান? ওই যে, ‘বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে’, ওইটা। কী যে বলো, মানুষ আবার গান হয় নাকি? বিরহ আবার মধুর হতে পারে? সাদা কাগজে আঁচড় কাটতে কাটতে এইসব ভেবে চলেছে মাধ্যমিকের ছেলে। ওর জ্বরের গায়ে বাদামী আলোয়ান। আজ বৃষ্টি হয়েছিল খুব। ভূগোল স্যারের গেট দু’ভাগ ছিল জলে। দু’ভাগ ছিল সাইকেল আর সালোয়ারের দল। তার মধ্যেই কোথায় যেন দাঁড়িয়েছিল সেই পাঁচ মিনিট। সেই পাঁচ মিনিট শুধু একসাথে দাঁড়িয়েছিল ওরা। সেই পাঁচ মিনিট পৃথিবীও থমকে যায় যেন, দাঁতে নখ কাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সেই পাঁচ মিনিট হয়ে ওঠে অনন্তকাল। তারপর স্থির জলে ছায়া কাটে সাইকেল, রিক্সাকাকুরা ঘড়ি দেখে নেয়। ফিরতি পথে ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ আসে মনে, ভিজে হাওয়ায় পাকিয়ে ওঠে জ্বর। জ্বরের গায়ে বাদামী আলোয়ান। একে ওর বিরহ মনে হয়, অথচ গুটিসুটি জড়িয়ে থাকতে কেমন একটা ইচ্ছেও করে খুব। একটি লোক হেঁটে যায় হেমন্তের নিঝুম পাড়ায়, একা – যেন তেমন কোথাও যাওয়ার নেই তার। মাধ্যমিকের ছেলে গুনগুন করে, ‘পরানে আমার পথহারা ঘুরে মরে’। চমকে ওঠে ও। এই তো একটা মানুষ কেমন সুন্দর হয়ে উঠল গান! আর ওর এই জ্বর, মায়ের জলপট্টি, বাদামী আলোয়ান – এই সবকিছু ওকে কেমন দাঁড় করিয়ে দিল সেই পাঁচ মিনিটের মুখে, আজীবন। এতে কী আশ্চর্য একটা আনন্দ হচ্ছে ওর! স্পষ্ট বুঝতে পারছে ও এখন, বিরহ কেমন মধুর হতে পারে এই পৃথিবীতে।



সাদা কাগজের আঁচড় অক্ষর হয়ে ফুটে উঠছে তাই, শব্দ টেনে নিচ্ছে শব্দ তার গায়ে। কাঁচা হাতের প্রথম কবিতায় সেই পাঁচ মিনিট বাঁধা পড়ছে চিরদিনের মতো। হে মহাকাল, তুমি তাকে আগলে রেখো বুকে – দেখো, মাধ্যমিকের পাগল ছেলে যেন তাকে আজীবন লিখে যেতে পারে...



(২)


রাত শেষ হয়ে এলে, যখন লেকের ধার থেকে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায় কবোষ্ণ বাষ্পেরা, তখন কাঁপা কাঁপা জলে নীলচে-সাদা প্রতিচ্ছায়াগুলো জেগে থাকে একা। ঘুমন্ত অর্ধপৃথিবীর বুকে যখন অভিমান ছাড়া কেউ পাশে নেই, তখন চোখের পাতায় শিশির নয়, ভাঙন এক দুরন্ত স্রোতের।

স্তব্ধতা ঝড়ের পূর্বলক্ষণ নয়, প্রতিশব্দ। যে হাওয়ায় আলুথালু উড়ে যায় অ্যানালিসিসের নোটস্, তার মুখে স্বপ্নের চারাগাছ কী অসম্ভব যন্ত্রণায় মাথা তুলে থাকে! পৃথিবীতে কতদিন, কতবার সবার অলক্ষ্যে ঠিকই বৃষ্টি পড়ে যায়। মরীচিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্লান্তি নয়, তাড়া করে অনিবার্য বিপন্নতা এক।



দু’দন্ডের প্রত্যাশারা অপেক্ষায় থাকে অনন্তকাল। অনন্তের সংজ্ঞা আমার জানা নেই, জানা নেই অসীম ঠিক কতদূর অবধি ব্যাপ্ত হতে পারে। শুধু নিজের মধ্যে নিজে ঝরে যেতে যেতে, ঝরে যেতে যেতে কী গভীর স্পর্ধায় বিশ্বাস জাগে, তোর জন্য ঠিক অসীম পর্যন্তই ঝরে যেতে পারি! ‘লিমিট এন্ টেন্ডস্ টু ইনফিনিটি’ অঙ্কগুলোর উত্তর আর মিলতে চায় না এখন।



নিবিড় অসহায়তার খড়কুটোদের ইচ্ছে নয়, অস্তিত্ব বলা হয়ে থাকে। মেরু থেকে বিষুবের পথে উড়ানের দিনে একমুঠো হাওয়া ভেসে গেলে ’পর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় তুষারমানব। আর হাওয়াগুলো সব নদী ছুঁয়ে-সমুদ্র ছুঁয়ে, দেশ ছুঁয়ে-বিদেশ ছুঁয়ে, মেঘ ছুঁয়ে-বৃষ্টি ছুঁয়ে বয়ে যেতে যেতে হাত রাখে নতুন কোনো অস্তিত্বের হাতে। পলাতক কান্নারা আজকাল রোজ ধরা পড়ে যায়। কালও তুই পাশ থেকে উঠে গিয়েছিলি...



(৩)


তোমার ও আমার মাঝে পড়ে ছিল বন্ধুর ছোটবেলা। দু’দিক থেকে আমরা দু’জন এই এমনি হাত বাড়াতেই আস্ত একটা হাটবাজারের বুকের মধ্যে পুঁচকে ফড়িং পা ফসকে কী যাচ্ছেতাই... আমি তো হুশমুশ ছুটে শেষ বল লুফে নিতে চাই। মুঠো খুলতেই দেখি, শহরের সবক’টা গলি আলগোছে ভিজে কাক হাতের রেখায়। এখানেই আমাদের দাঁড়ানোর কথা ছিল। তোমার ও আমার মাঝে পড়ে ছিল বন্ধুর ছোটবেলা, নড়বড়ে সাঁকো হয়ে পড়ে ছিল দায় – কণ্ঠে নেওয়ার মতো কড়িটুকু, শেষ পারানির...



সেইসব হেঁটে যাওয়া ঘিরে ছোট ছোট পথ আঁকে শহরের তুলি। আকাশের নখে ধুলোর জমাট। অভিমান পেরিয়ে আর একটুখানি গেলেই রাত্তির লেগে যায় টিউশনির ব্যাগে। তাকে কোলেপিঠে করে ঘরে ঢুকতেই বর্ষণ নিয়মমাফিক। জল সরে গেলে সরে যাবে সব পথের রেখাও। গর্তের হাঁ-মুখ ভর্তি ছোপ ছোপ সাদাকালো রং – ওইটুকু স্মৃতি। তাকে বুকে ধরে সমস্ত সাইকেল যার যার ঘরে চলে গেছে বহুদিন। টিমটিমে আলোদু’টো নিভিয়ে দিয়েছেন টিউশনির স্যার। সবটা পাল্টে গেলেও বারবার ওই একই প্রশ্ন তুলে আনবে মাধ্যমিক, সকলেই জানে...



(৪)


শুধু দূর থেকে তার জেগে থাকাটুকু দেখি, ক্যাম্পাসের এই ঝিঁঝিঁ ডাকা রাতে অফুরান সেই জেগে থাকাটুকু। আধখোলা জানলা দিয়ে ঠিক এই সময় যেমন চুপিচুপি ঘরে আসে হাওয়া; তারপর খুব আলতো করে ছুঁয়ে যায় তার চোখের পাতা, নরম কপাল, আর সাবধানে জানলার শিক গলে ফিরে যায় তারপর, তেমনি চুপিচুপি তার সাথে জেগে থাকি সারারাত। অচেনা আলোর মত ছুঁয়ে থাকি তাকে, অজান্তেই। কাল সকাল হতেই লুকিয়ে পড়ব ঠিক। ঘুমের গন্ধের মত লেগে থাকব আদুরে পাশবালিশের গায়ে। আবারও রাত্রি হবে। তখন স্বপ্নের রঙে রঙে মিশে জোনাকির মত উড়ে বেড়াব ঘরময়। ভীষণ বৃষ্টি নামবে তখন। ছাদের উপর দাপিয়ে ছুটবে ঘোড়সওয়ার। উন্মাদ সেই শব্দের ভিড়ে চাপা পড়ে যাবে গোপন কথা, পদক্ষেপের। শিউলিপাতার কিনার বেয়ে টলমল ঝরে যাবে মরশুমি জলবিন্দু সব। তারপর আমাদের সবটুকু জেগে থাকা পায়ে পায়ে গান হয়ে যাবে...



(৫)


বাড়ি ছেড়ে চলে গেছ, এমন পাড়ার মতো দুঃসহ হয়ে ওঠে ফেসবুক দিনে দিনে। এ লেখা পৌঁছে দেবে না কখনও কোথাও – তবু আমি পা রাখি এহেন পেডালে, পড়শির চোখটুকু নীরবে পেরোই – তারপর খেই হারিয়ে ঘুরে মরি মফস্বলের গলি। আমার অতিদূর চেয়ে থাকাটুকু নিয়ে সংসার গুটোয় শূন্য ছাদের রোদ, মেঘরঙ বিষাদের ছায়া সারাটা আকাশ ঘিরে কিত্ কিত্ খেলে – এইসব এক্সপ্রেশন ছেড়ে আমার আর যাওয়া হল না অন্য কোথাও। শুধু নিশ্চিত জানি, লাজুক বৃষ্টি হলে এ লেখায় জেগে উঠবে একমুঠো জোনাকি-বাগান; তার থেকে অনেকটা দূর তোমার নামের পাশে সবুজ আলোর নাইটল্যাম্প নিভিয়ে দেবে তুমি। তোমার এই ঘুমিয়ে পড়ার গায়ে আমি লিখে রাখি দীর্ঘ কবিতা, কাগুজে প্লেনের মতো তাক করে থাকি শব্দ রাতভর – অথচ কী জানি কী মনে করে একটানা চেপে রাখা ব্যাকস্পেস বোঝে, আলো-আঁধারির ভোরে চুপিচুপি মরে গেল যত-না আখর, তার চেয়ে ঢের বেশি শুদ্ধ কোনও ভয় লতানো পথের মতো দুরুদুরু পড়ে ছিল মাঝখানে তোমার ও আমার। অভিসারের এহেন আর্কেটাইপে সহসা তুমি লুকিয়ে ফেলো মুখ, সাদা-ছোপ ধূসর পর্দা নিথর ঝুলে থাকে হোয়াটস্যাপের শূন্য জানলায়। কিন্তু যে চিঠি নিয়ে পাড়ি দিল উদাসী পিওন, দূরাভাসী ট্রেন তার দপদপে আলো বুকে ঢুকে এল তোমার শহরে – কী হবে তাদের? উত্তরে চুপ থাকো তুমি। ছেড়ে যাওয়া বাড়িটির দিকে চুপ করে চেয়ে থাকে চায়ের দোকান। যেন ঠিক একটুখানি বৃষ্টি হবে, এমন একটা অবুঝ হাওয়ায় ক্যালেন্ডার ঝাপটে ওঠে দেওয়ালে দেওয়ালে – এইসব ইমেজারি ছেড়ে আমার আর যাওয়া হবে না অন্য কোথাও। অবশ্য পাড়াবেড়ানো এসব লাইন তুমি পেরিয়ে এসেছ বহুকাল। ধরতাই আঁচ করতেই খিল দিয়েছ সমস্ত দরজায়। দীর্ঘ কবিতার দীর্ঘতর ব্যাকস্পেসে মুছে ফেলেছ পুরোনো ঠিকানা – অযথা শ্রাবণ ভেবে আমি চোখ বন্ধ করেছি...



অথচ তোমার চেয়ে ভালো কে-ই বা জানতো, ‘পিছনে যা রেখে আসি সেটাই ক্যারিয়ার হয়ে যায়’ কি না?


Comments

অনিন্দিতা said…
অসাধারন 🖤

আরও পড়ুন

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৩

২৩ | ফেব্রুয়ারি সংখ্যা | ২০২৫

তৃতীয়— মাস-সংক্রান্ত

রঙ্গন রায়

কবিতা গুচ্ছ

জুজুতন্ত্রের সমূহ শ্বাপদ এবং হুজ্জতি

সিনেমা-বিষয়ক নিবন্ধ -- জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

একটি কবিতা সিরিজ —

সৌমিক মৈত্র

মনোজ চৌধুরী