সব্যসাচী মজুমদার



লিটল ম্যাগাজিন : একটি ধারনার কথা 

সব্যসাচী মজুমদার


১.

'দিগদর্শন'থেকে বাংলাদেশে সাময়িক পত্রের সূচনা হলেও যে অর্থে লিটল ম্যাগাজিন বোঝায়,যে মেজাজ ও উদ্দেশ্যকে নির্দিষ্ট করে, তা কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর প্রকাশনাগুলোতে বিরল দৃষ্ট।একে অপরকে দোষারোপ করতে কিংবা ব্যাক্তি মত প্রতিষ্ঠা করতে সাময়িক পত্রের যে প্রকাশিত হয়নি তাও নয়।তত্ত্ববোধিনী , সম্বাদ প্রভাকর,সম্বাদ কৌমুদী,বঙ্গদূত, সমাচার চন্দ্রিকা,সম্বাদ ভাস্বর হয়ে বঙ্গদর্শন পর্যন্ত যে যুগ,তাতে আজকের লিটল ম্যাগাজিনের বোধ খুব বেশি জারিত হয়নি।অবশ্য‌ই ঈশ্বর গুপ্তের নেতৃত্বে সম্বাদ প্রভাকর আর বঙ্কিমের প্রেরণায় বঙ্গদর্শন গোষ্ঠী নিয়মিত সমকালীন সাহিত্য চিন্তার ধারক হয়ে লেখক গোষ্ঠী তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। বিশেষ করে সম্বাদ প্রভাকরের উন্মাদনার প্রহর তার প্রকাশনাগুলিতেই বিশেষ অনুভব করা যায় ‌‌। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্ত মন দিয়েছিলেন সংবাদ পরিবেশনে‌ও। হ্যাঁ,রাজনীতি লিটল ম্যাগাজিনের অবশ্যম্ভাবী স্বভাব হলেও সে আওতায় থাকবে সাহিত্যের কিংবা অন্তর্গত বিশ্লেষণের। তথ্য নির্ভর সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন ধারণার বাইরে নিয়ে যায় সম্বাদ প্রভাকরকে।যেমন বঙ্গদর্শন‌ও পৌঁছে যায়নি সাহিত্যের চলতি ধারাতেও।একপ্রকার বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে চেয়েছিল।বিনির্মাণে বিশ্বাস রেখেছিল কী! আজকের সময় দাঁড়িয়ে কিন্তু একথা ভাবাই যেতে পারে,বঙ্গদর্শন আসলে লেগাসি বহন করতে চেয়েছিল অধিকতর।লেগাসির বিনির্মাণের কথা হয়তো ভাবতে চায়নি।ভারতী'কেও এই স্বভাবের আওতায় রাখা যেতে পারে।

২.                                                              

'লিটল ম্যাগাজিন ' শব্দটিকে প্রথম ব্যবহার করেন বুদ্ধদেব বসু। এবং তিনি 'সবুজ পত্র 'কে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন মনে করতেন।যদিও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা 'পত্রিকাকে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের সুচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করলে,রসিকজনের বিশেষ আপত্তির কারণ হবে না। একদিকে 'আধুনিক কবিতার 'প্রোপাগান্ডাকে বঙ্গমণীষায় অনিবার্য করে তোলা যেমন লক্ষ্য ছিল,অপর দিকে জীবনানন্দ দাশ থেকে আনন্দ বাগচী কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলা কবিতার প্রয়োজনীয় পাঠ বলে চিহ্নিত করে দেওয়ার বিপুল অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে।এর‌ই পূর্ববর্তী প্রহর আমরা ঘটে যেতে দেখি 'কল্লোল'কাগজে।অথবা প্রায় সমকালীন 'পরিচয়'য়েও এক‌ই প্রবাহ লক্ষ করি। একদিকে একটা নির্দিষ্ট একটি মতের সর্বময় প্রচার।মতের উভয় অর্থে 'দ্বন্দ্ব'-কে ধারণ করে চিন্তার বিনির্মাণ ঘটাতে চাইতো কাগজগুলো।তেমন‌ই রাজনীতি ও গোষ্ঠী ব্যাতিরেকে সকলের লেখা প্রকাশের মুক্ত আয়োজন ও তার মধ্যেই নির্দিষ্ট লেখক গোষ্ঠী তৈরি করা;যাঁরা ভবিতব্য হিসেবে বহন করবেন লেগাসির ক্রম বিনির্মাণ।সেই সঙ্গে আয়তনের অনির্দিষ্ট স্বল্পতা ও মেজাজে ম্যাগাজিনের সামীপ্য বজায় রাখাই লিটল ম্যাগাজিনের স্বভাব।তবে কিনা,এর কোন‌ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা তো নেই।তাই অবস্হা বা পরিস্থিতি ভেদে লিটল ম্যাগাজিন তার স্বভাব অল্প বিস্তর বদলেছে। কিন্তু সর্বদাই যাকে অবিরল প্রশ্রয় দিয়েছে,তা হলো তরুণ কবির পরীক্ষা -নিরীক্ষার স্পর্ধা।এই স্পর্ধাটুকুই তাকে সদা স্পন্দিত ম্যাগাজিনে পরিণত করে। আয়তনের স্বল্পতা‌ই কী কেবল লিটল -এর উৎস!আয়তন যা হতে পারে,কুড়ি ফর্মার বা তিন ফর্মার,তা যেন ছোটো মানুষের ম্যাগাজিন,সোচ্চার 'না'-এর অগ্রবীজ হয়ে থাকতে পারে।তাই অনুষ্টুপ-এর 'ইরাক এবং এখন 'সংখ্যা কিংবা দিবারাত্রির কাব্যের 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যা ' লিটল ম্যাগাজিনের ধ্রুপদী উদাহরণ হয়ে থাকবে।কিংবা শিলীন্ধ্র-এর 'বিষ্ণু দে সংখ্যা '-কে 'মননের মধু 'বলতে আপনার আপত্তির কোন‌ও কারণ‌ই দেখা যাচ্ছে না।

৩.

উত্তর 'কবিতা'পর্বে বাঙালির লিটল ম্যাগাজিনের সৌরক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল 'কৃত্তিবাস'পত্রিকা। সবচাইতে প্রভাব বিস্তারকারী এই কাগজটির অবিসংবাদী উপস্হিতি আজও বিলক্ষণ অনুভব করা যায়। কৃত্তিবাসের এই প্রভূততম সাফল্যের পেছনে কেবল নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ‌ই দায়ি,তা মনে করছি না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নিখুঁত সম্পাদনাও সমানভাবে সক্রিয় ছিল বলেই বিশ্বাসবাসি।


একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রেখে যত বেশি সম্ভব তরুণ কবির কবিতা ছাপতে ছাপতে তার মধ্যেই বাংলা কবিতার অব্যবহিত পরের সময়কে নিয়ন্ত্রণকারী কবি গোষ্ঠীও তৈরি করে গিয়েছেন একের পর এক।এই কাজটির সঙ্গে তিনি আর‌ও একটি কাজ করেছেন,যেখানে কমার্শিয়াল ম্যাগাজিন‌ পৌঁছয় , সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন।এটাই তো আন্দোলন।একটা কুপবদ্ধ হয়ে না থেকে সহজভাবে নিজের মতকে এবং এক‌ই সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে তরুণ প্রজন্মের কবিতাকেও সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।যাতে কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনে লিখতে না চাওয়া প্রতিস্পর্ধার লেখাও সমানভাবে পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। এই স্বভাব বজায় রাখতে না পারলে প্রকাশনা হয়তো লিটল ম্যাগাজিন হবে কিন্তু আন্দোলন বিচ্যুত হবেই।


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনার প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে,এই অধুনালুপ্ত সম্পাদনা বিষয়টি কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের অনিবার্য একটি অঙ্গ।সম্পাদক কখনও লেখকের ওপর চেপে বসবেন না যেমন,তাঁর অনুপস্থিতিও উপলব্ধি করা যাবে না।অনেকটা ফরাসি সুন্দরীদের মেক আপের মতো।প্রচ্ছন্নভাবে তাঁর রুচি ও পাঠ পরিকল্পনা পাওয়া যাবে লেখক নির্বাচনে।বিষয় নির্বাচনে। এবং লেখার মান নির্মাণে।মনে রাখবেন,আপনি যিনি এই নিবন্ধটি পাঠ করছেন -- আদ্যন্ত লিটল ম্যাগাজিনের লেখক হলেও, আপনার শ্রেষ্ঠ লেখাটি প্রকাশ করতে পছন্দ করবেন অধুনার গদ্য পদ্য প্রবন্ধে বা আবহমান কিংবা ভাষানগরে। কেননা,তাঁরা মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যেমন, তেমনই আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছে সমকালীন ক্রম বিনির্মীত সময়ে। নিজেকে নিজের সঙ্গে প্রতিদিন কিভাবে লড়তে হয়, কিভাবে রোজ‌ই নিজেকে অতিক্রম করতে হয়,এই ধরণের সুসম্পাদিত কাগজ‌ই সেটা একজন লেখকের মর্মে প্রবেশ করাতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে আপনার মনে পড়ে যায়,ঈক্ষণ -শতভীষা-বিভাব-রক্তমাংসের কথা।কবিসম্মেলন কুড়ি বছর যাবৎ যে কাজটি করে গেছে। কৃত্তিবাসের পর পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিনের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বোধহয় কবিসম্মেলনের‌ই‌।কৌরব ,দাহপত্র,কবিতা পাক্ষিক,শিস,দাহপত্র ,জেব্রা,এষণা,ইসক্রা, এবং মুশায়েরা, জিরাফ,এরকা,শহর,বোবাযুদ্ধ ,অমৃতলোকের প্রভাবকে অস্বীকার না করেও এ কথা বলাই যায়।


কেবল লেখা ও লেখক তালিকা তৈরি করে, তাঁদের লেখা ছাপানোতেই  সম্পাদনার কাজটা শেষ হয়ে যায় না। এবং সেটা মনে রাখতে হয়,বোধশব্দ, বৃষ্টিদিন -এর কাজগুলো দেখতে দেখতে ‌। শিল্প বিষয়ক পর্যালোচনার হলেও 'টেরাকোটা'র এক একটা সংখ্যা বিশেষভাবে সংরক্ষণ যোগ্য। বৃষ্টিদিন এক দশক ধরে ভারতীয় কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে আর সমকালীন কবিদের সম্পূর্ণ পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছে,তার তুলনীয় ইতিবৃত্ত সহজ দৃষ্ট নয়।আর ঠিক আগের দশকের বিজল্প যে কাজটি করেছে।


কত যে অজস্র কাগজের কত সংরক্ষকের ঈর্ষার প্রকাশনা রয়ে গেল উল্লেখ ও আলোচকের জানার বাইরে,তার আক্ষেপ কখনও মেটার নয়।কারণ বাঙালি বোমা মারা ছেড়ে দেওয়ার পর এই লিটল ম্যাগাজিনকেই এমন অস্ত্রাগারে পরিণত করে নিয়েছে যে এখনও শাসক কান পেতে থাকে চারটে লিটল ম্যাগাজিন কর্মীর একান্তই চা -পানের আসরে।মা হোক প্রসঙ্গে ফেরা যাক।স্বভাব বিদ্রোহী বাঙালির পাল্টা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভ্যাস তো সেই চর্যাপদ থেকেই। অর্থনীতি বদলালেও স্বভাব অপরিবর্তনীয়।সে ভাব দিগদর্শন থেকে বান্ধব নগর পর্যন্ত সমানভাবে সক্রিয়।


৪.


সঙ্গত কারণেই লিটল ম্যাগাজিন বিবর্তিত হবে ই-ম্যাগাজিনে। এটা ইতিহাসের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারেই ঘটবে।লিপিকরদের সরিয়ে ছাপাখানা এসেছে। ফাউন্টেন উঠে ডট গিয়ে এখন ভার্চুয়াল লেখা শুরু হয়ে গেছে।এতে লেখার গঠন‌ও বদলাচ্ছে। শিলালিপি উঠে ব‌ই এসেছিল বলে আপনি যেমন সুখী হয়েছেন,এই বিবর্তনকেও স্বাগত জানাতে হবে। ইতিমধ্যেই বাক,বোম্বেডাক,অপরজন,চার নম্বর প্লাটফর্ম; সঙ্গে সঙ্গে দু'রকম ফরম্যাটে প্রকাশিত হলেও প্রধানতঃ ই-ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশিত গদ্য পদ্য প্রবন্ধ ও আবহমান;  এ - কথার প্রমাণ হিসেবে বাংলা ভাষার সম্ভাব্য রূপকে তৈরি করছে।বদল হোক। ঘটুক অজস্র নিরীক্ষা। বদলে যাক সচরাচরের ঢং।লিটল ম্যাগাজিন স্বতঃবিনির্মাণে জীবিত থাকে।যার চেষ্টা কী দেখি না নীললোহিত, মধ্যবর্তী, গুহালিপি, বান্ধবনগর, যাপনচিত্র কিংবা মান্দাসে!

আশু ভবিষ্যতে হয়তো লিটল ম্যাগাজিন এই আকারে প্রকাশিত হবে না।সবটাই ইন্টারনেট ধারণ করবে। কিন্তু যেটা বদলাবে না,সেটা হলো স্পর্ধা,প্রতিস্পর্ধার ধারা।প্রত্যেকটা ই-ম্যাগাজিন আসলে হয়ে উঠবে 'যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' নামার উপায়।


লিটল ম্যাগাজিন গত আন্দোলনের দলিল। চিন্তার নথিআ।যতদিন মানুষের সমাজ নামক ধারণা থাকবে লিটল ম্যাগাজিনের ধারণাও অবিনাশী।



"  তবে যে রুচি আচার্য সুধীর চক্রবর্তী স্হির করে গিয়েছেন 'ধ্রুবপদ'-এ ,তা থেকে কখন‌ই বিচ্যুত হবে না বটে তবে 'শনিবারের চিঠি 'ও একজন সজনীকান্ত দাশ-কে থাকতেই হবে।ন‌ইলে বৃত্ত সম্পূর্ণ হ‌ওয়ার নয়।  "


Comments

আরও পড়ুন

একটি কবিতা সিরিজ —

গুচ্ছ কবিতা —

একটি কবিতা সিরিজ

বীথিকা ধরে হেঁটেছে দীন

এক গুচ্ছ শিশির আজম

একটি কবিতা সিরিজ

কবিতা গুচ্ছ

উপসংহার থেকে ফিরছি —কবিতা সিরিজ

তিস্তা পাড়ের মেয়েটি— কবিতা সিরিজ

সম্পর্কগাছ— কবিতা সিরিজ