তৃতীয় —মাস-সংক্রান্ত






ওমর খৈয়াম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন হিজরী পঞ্চম শতকের শেষের দিকে সেলজুক যুগে। তিনি ছিলেন মালিক শাহ সেলজুকের সমসাময়িক। অনেক ইতিহাসবিদের মতে সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছু আগে ওমর খৈয়াম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এখনকার ইরানের পুরাতন নাম ছিল পারস্য আর তার রাজধানী ছিল খোরাসান। ইরানের নিশাপুর শহরে ওমরের জন্ম। তার পিতা ছিলেন তাঁবুর কারিগর ও মৃৎশিল্পী। ছোটবেলায় তিনি বালি শহরে সে সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত শেখ মুহাম্মদ মানসুরীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেন। যৌবনে তিনি ইমাম মোআফ্ফাক-এর অধীনে পড়াশোনা করেন। ওমর খৈয়ামের শৈশবের কিছু সময় কেটেছে অধুনা আফগানিস্তানের বালক্ শহরে। সেখানে তিনি বিখ্যাত মনীষী মহাম্মদ মনসুরীর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে তিনি খোরাসানের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত ইমাম মোয়াফ্ফেক নিশাপুরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জীবনের পুরো সময় জুড়ে ওমর তার সব কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। দিনের বেলায় জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়ানো, সন্ধ্যায় মালিক-শাহ-এর দরবারে পরামর্শ প্রদান এবং রাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চ্চার পাশাপাশি জালালি বর্ষপঞ্জি সংশোধন! সবটাতে তার নিষ্ঠার কোন কমতি ছিল না। ইসফাহান শহরে ওমরের দিনগুলি খুবই কার্যকর ছিল। কিন্তু আততায়ীর হাতে সুলতান মালিক শাহ-এর মৃত্যুর পর তার বিধবা পত্নী ওমরের ওপর রুষ্ঠ হলে ওমর হজ্ব করার জন্য মক্কা ও মদীনায় চলে যান।পরে তাকে নিশাপুরে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। নিশাপুরে ওমর গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিষয়ক তার বিখ্যাত কাজগুলো সম্পন্ন করেন।




রুবাই— 

কেবল কবিতার একটি বিশেষ ফর্ম বা জঁর নয়; ফিলোসফিক্যাল আর্গুমেন্ট। চারটি পঙক্তি চারটি বচনের মতো ব্যবহৃত কাব্যিক যুক্তি। আবার রাজনৈতিক বয়ানও।

ওমর খৈয়ামের লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক কাল চেতনা ও ধারণা। মনে রাখা দরকার, খৈয়াম কবি হওয়ার পাশাপাশি একজন জ্যোতির্বিদও ছিলেন। তাঁর সময় ধারণা রৈখিক। কিন্তু তা খ্রিস্টিয় ইহকালের মতো চিরন্তন পরকালের মুখাপেক্ষী নয়। বরং ইসলামী চিন্তায় পরকালের সমান বাস্তব; পরকাল এখানে ইহকালের অনুগামী, অপ্রধান। আবার বৌদ্ধদের মতো প্রতীত্যসমুৎপাদে ক্ষণবাদী নয় এই কাল চেতনা। বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর দুটি সময় ধারাবাহিকতার আপেক্ষিক সহগমন তাঁর রুবাইয়ে প্রধান। ফলে কালচিন্তায় তাৎক্ষণিকতা ও বৃহত্তরতা নিয়ে খৈয়ামের ছেলখেলা অপূর্ব আবহ তৈরি করতে পারে। কখনও প্লেটোর আকারের ধারণাও (Idea of Form) মনে আসতে পারে কালচিন্তার সঙ্গে।


ইসলামী দর্শনের অনুসঙ্গ থাকলেও খৈয়ামের রুবাইয়ে পারস্য জাত্যাভিমান প্রবল। আর এই প্রত্যয়ই তাঁকে ক'রে তোলে প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম ও ইরানে আরবের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিপক্ষ। এখন ছোট পরিসরে কেবল এটুকু বলার;— কাব্যিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনেই বারবার তাই খৈয়াম অনুদিত হয়েছে, হবে। এই প্রচেষ্টা সেই পরম্পরার একটি বিন্দু। ধন্যবাদ।


Edward FitzGerald-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে করা হয়েছে।

বাংলা ভাষান্তর

—মাসুদ শাওন


(১)


রুটি আর মদ নিয়ে বসি গাছের ছায়ায় 

তুমি আছো আর সাথে খোদার আয়াত

গান গাও পাশ থেকে উন্মন উচ্ছাসে

এ মরুভূমিকে আজ আমাদের বেহেস্ত বানাই



(২)


তখন এ-আকাশে নকল ফজর গিয়েছে মরে 

ঘুম ভাঙে, শুনি মধুশালা ডেকে বলে তারস্বরে

ওঠ্ রে বালক, শূন্য পাত্র তোর খালি

জীবনের মদে বেহেস্তের পেয়ালা আজ নে ভরে


(৩)


মোরগের বাঙ্ শুনি, সাকি, খোলো এ দূয়ার 

ডাকে মাতোয়ারা জমায়েত বাইরে বার-বার

কে জানে কতই বা সময় রয়েছে বাকি

এইবার চলে গেলে ঠিক নেই আবার ফেরার


(৪)


নতুন বছর আজ বয়ে আনে পুরোনো বাসনা

কথকতা ছেড়ে খুদী চলে নির্জনের প্রেরণায়

নিভে গেলে মোযেসের হাতে শুভ্র জীবন সংকেত

দীর্ঘশ্বাসে জেগে ওঠে মাটি থেকে ঈশার বেদনা


(৫)


স্বপ্নের গুলবাগ ইরম গিয়েছে চলে কবে

আর ভুলে গেছে জামশিদের পেয়ালা সবাই

নদীর কিনারে তবু এখনও মাথা নাড়ে ঘাস

আঙুর রসের বুক চিরে উঁকি দেয় পুরাতন রুবি


(৬)


দাউদের কথা থেমে অলৌকিক ঘোরে যেন

বলে পেহলেভি ভাষায়, শরাব! শরাব! শরাব আনো!

উষ্ণ লাল মদ চেয়ে কাতর বুলবুলি গোলাপের দিকে

এগোয় হলুদ ঠোঁটে আর মাতে মদে ঠোঁট রাঙানোয়



(৭)


এসো, ভরে নাও পেয়ালা বসন্ত আগমনে

অনুশোচনার শীতও চলে গিয়েছে তর্পনে

সময়ের পাখি এই এখনই তো উড়ে যাবে

আর ওই ডানা মেলে দিল পাখি হঠাৎ আনমনে


ওমর খৈয়াম(১০৪৮-১১৩১)





Comments

আরও পড়ুন

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৩

২৩ | ফেব্রুয়ারি সংখ্যা | ২০২৫

রঙ্গন রায়

তৃতীয়— মাস-সংক্রান্ত

কবিতা গুচ্ছ

সিনেমা-বিষয়ক নিবন্ধ -- জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

একটি কবিতা সিরিজ —

সৌমিক মৈত্র

মনোজ চৌধুরী

লিটল ম্যাগাজিন ও ফিনিক্স মিথ