অবগুণ্ঠন সাহিত্য পত্র ও কিছু কথা— অমিতাভ দাস

 







অবগুণ্ঠন এর শুরুটা হঠাৎ করেই হয়েছিল। নিজের ও বন্ধুদের লেখা ছাপা হবে, এইটেই আসল কারণ। আমরা তখন অনেক লিখতাম বটে কিন্তু ছাপার জায়গা ছিল না। সেই '৯৪ '৯৫ '৯৬ সালে এত পত্রিকা কোথায়? আমাদের অঞ্চলে যেসব পত্রিকা ছিল তার সম্পাদকেরা লেখা ছাপা হলে কেউ পাঁচটা, কেউ দশটা পত্রিকা হাতে গছিয়ে দিত। বলত বিক্রি করে টাকা তুলে দিতে হবে। আমরা বিক্রিও করে দিতাম। আত্মীয় পরিজনদের কাছে। কিন্তু এভাবে তো বেশি দিন চলে না। ডাকে লেখা পাঠাতাম। কোথাও ছাপা হত, কোথাও হত না। আমাদের নিজস্ব একটা প্লাটফর্ম দরকার ছিল। যেখানে আমরা আমাদের কথা বলব। অবগুণ্ঠন হল সেই প্লাটফর্ম ।

('৯৬ সালের প্রথম সংখ্যা)


অবগুণ্ঠনের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল অনাড়ম্বর ভাবেই। '৯৬ সালের কালীপুজোর আগের দিন। প্রেস থেকে পত্রিকা সাইকেলের কেরিয়ারে বেঁধে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম দুপুরবেলা। উফ্ সে কী আনন্দ। বিকেলে অশোকনগর থেকে আমার দুই বন্ধু শুভাশিস চক্রবর্তী আর অনির্বাণ দাস এলো। আর যতদূর মনে পড়ছে সৌরভ চাটুজ্যে এসেছিল। খুব গল্প হল। আড্ডা হল। কবিতা পড়া হল আমাদের ছোট্ট গোল ঘরে বসে।

           মনে আছে হলুদ রঙের কভার। প্রচ্ছদ ছিল না। অবগুণ্ঠনের নিজস্ব লোগোও ছিল না। তবে প্রথম সংখ্যাতেই বিনয়দা, কবি বিনয় মজুমদার লেখা দিয়েছিলেন। সেই সময় অনেক লেখা ডাকেই এসেছিল। আমরা পেয়েছিলাম নির্মল হালদার, আবীর সিংহ, সত্য গুহ, পঙ্কজ মন্ডল, তাপস রায় প্রমুখের কবিতা। সেই শুরু। তারপর কেমন যেন একটা নেশার মতো হয়ে গেল পত্রিকা করাটা। আর ছাড়তে পারিনি। আফিমের থেকেও বড় তীব্র এই নেশা।যার হয়েছে সে জানে।

   

স্কুল জীবন সবে মাত্র শেষ হয়েছে। কলেজ জীবনের শুরু। এক অদ্ভুত উন্মাদনা। কলেজে পেয়ে গেলাম কবি বিজয় সিংহ, মোল্লা সাহাবুদ্দিন, শিবাজীপ্রতিম বসুকে। তাঁদের সরাসরি উৎসাহ ও কবিতাচর্চা আমাদের পত্রিকা প্রকাশের আগ্রহকে বাড়িয়ে দিলো। ঠিক সেই সময়, অনির্বাণ দাস শুরু করল "অহর্নিশ" পত্রিকা, সাগর সেনের " ভালোবাসা", সৌরভের " কবিজন্ম " প্রকাশিত হল। আমাদের তরুণ তরুণতম কবিদের লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে হৈ হৈ উন্মাদনা শুরু হয়ে গেল। আজ এত বছর পর পেছন ফিরে দেখি বন্ধুদের পত্রিকাগুলি কালের নিয়মে বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁরাও সংসার-জীবনে ও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি এখনো ২৭ বছর ধরে অবগুন্ঠন পত্রিকাটির সম্পাদনা করে চলেছি। শীঘ্র-ই পত্রিকার ৫০তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হবে বিশেষ ছোটোগল্প সংখ্যা হিসেবে।

                       এত বছরে যে খুব বড় কোনো কাজ করে ফেলেছে অবগুণ্ঠন একথা আমি বলি না। হয়তো ভাবনাটা বড় ছিল। আর্থিক সংস্থান ছিল না। খুব সাদামাটা ভাবেই কাগজ করতাম। এখন তাও পত্রিকা বিক্রি হয়। সেই সময় একদম বিক্রি হত না। বিলি-বন্টনেই দুশো-তিনশো কপি কাগজ উড়ে যেত। কত চিঠি আসত ডাকে। আলোচনা-সমালোচনামূলক চিঠি। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মালদা, দার্জিলিং, কোচবিহার, আসাম, ত্রিপুরা থেকে চিঠি আসত। সব ডাকযোগেই পত্রিকা পাঠানো হত। তখন ডাক ব্যবস্থা ভীষণ ভালো ছিল।

                                 তখন তো আমাদের হাতে টাকা- পয়সা তেমন ছিল না। টিউশন করতাম। টিউশনের পয়সা বাঁচিয়ে, পুজোতে আত্মীয়রা টাকা দিলে, নতুন জামা না কিনে সে পয়সায় পত্রিকা করেছি। ২০০১ এর পর থেকে অবস্থাটা একটু একটু করে বদলাতে থাকে। সে সময় বেশ কয়েকটি ভালো সংখ্যা আমরা করেছিলাম সীমিত সামর্থে। যেমন কবিতা আলোচনা সংখ্যা, কবিতা বিষয়ক গদ্য সংখ্যা, স্বপ্ন সংখ্যা, রবীন্দ্র সংখ্যা ইত্যাদি। কবিতা সংখ্যা অনেকবার হয়েছে।



                                    ২০১২ সালের পর থেকে অবগুণ্ঠন অণুগল্পের চর্চা শুরু করে। প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই অণুগল্প থাকত। সেই শুরু হল আর এখনো অণুগল্পচর্চার ক্ষেত্রে অবগুণ্ঠন একটা উল্লেখযোগ্য নাম। বহু অণুগল্পকারের লেখার সূচনা অবগুণ্ঠনের সাদা পাতা। সেজন্য গর্ব হয়। সেই ২০১২ সালে আজকের দিনের মতো এত অণুগল্পের চর্চা বা প্রচার-প্রসার ছিল না। ২০১৯ সালে অবগুণ্ঠন অণুগল্প সংখ্যা প্রকাশ পায়। প্রায় ৫৩ জনের অণুগল্প, বিদেশী অণুগল্পের অনুবাদ ও অণুগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে একটা সংখ্যা। প্রচুর বিক্রি হয়েছে। এখনো পাঠকরা খোঁজ করেন। অণুগল্প চর্চার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংখ্যাটি। এ আমার কথা নয়। বহু বিশিষ্ট জন এ কথা বলেছেন।




                                        এরপর বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা আমরা প্রকাশ করেছি। যেমন, বিশেষ গল্পগ্রন্থ আলোচনা সংখ্যা, বিশেষ গল্প সংখ্যা, বিশেষ মুক্তগদ্য সংখ্যা। তাছাড়া প্রতিবার শারদ সংখ্যা তো আছেই। প্রথম দিকে অবগুণ্ঠন কবিতাচর্চার জন্য শুরু হলেও ২০১১ সালের পর থেকে গদ্যচর্চায় জোর দিতে থাকে। শেষ সাত-আট বছর তো গল্প-অণুগল্পের চর্চায় যুক্ত ছিল। এখনো আছে। 


লিটল ম্যাগাজিনের আদর্শকে মনেপ্রাণে লালন করেছি আমরা। আমাদের স্লোগান ছিল," অবগুণ্ঠন এক ফর্মাতেই আগুন জ্বালাতে সক্ষম। " মোটা থান ইটের মতো পত্রিকায় আস্থা বা বিশ্বাস আমাদের ছিল না। আজো নেই। আমরা সবসময় চাইতাম বা আজো চাই নতুনদের সুযোগ দেওয়া, তাদের লেখা ছাপা। স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদান, তাঁদের নিয়ে কাজ বা একটু আড়ালে থাকা, প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা লেখকদের তুলে ধরতে চেয়েছি আমরা। অবগুণ্ঠনেই প্রথম ছাপা হয় কবি দীপক রায়, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, জহর সেনগুপ্ত, গল্পকার ঋতুপর্ণ বিশ্বাস, সুব্রত বসু, দিলীপকুমার মিস্ত্রীর দীর্ঘ ও বিস্তারিত সাক্ষাৎকার।    

            আমরা বিশ্বাস করি একটি লিটিল ম্যাগাজিন পারে অন্য একটি লিটিল ম্যাগাজিনকে সম্মান জানাতে। এই ভাবনা থেকেই প্রতি বছর আমরা একটি ছোটো পত্রিকাকে সম্মান জানাই। এই সম্মান পেয়েছে মাটির কাছাকাছি, অহর্নিশ,  কণিকা, দৌড়, ধ্রুবতারা, সাইন্যাপস্, নান্দনিক,  পারক, খেয়া, পথের আলাপ প্রভৃতি পত্রিকা। খুব সীমিত সামর্থ আমাদের , তবু চেষ্টা করি। সাতাশটা বছর তো কম নয়।

                     আগে কষ্ট হত, মূলত অর্থের। এখন সে সমস্যা অনেকটাই কমেছে। এখন প্রিয়াঞ্জলি, মধুমিতা, শিখাদি, গৌতম, তন্ময়রা পত্রিকার সঙ্গে আছে। সঙ্গে আছে কিছু ভালো বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। তাঁদের কাছেও আমরা ঋণী। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ অবগুণ্ঠনের পাশে থেকেছে বলেই আজ এতদূর পথ চলতে পেরেছি। এতগুলো বছর ভালো-মন্দে এগিয়ে যেতে পেরেছি। বিশেষভাবে দুজনের কাছে ঋণ স্বীকার করতেই হবে, অরবিন্দ দাস এবং দীপক রঞ্জন ভট্টাচার্য । 

                             আগামী দিনেও আমরা আরো কাজ করতে চাই। সাধ থাকলেও সাধ্য তেমন নেই।  লিটল ম্যাগাজিন একটা বারুদের স্তুপ। আগুন। যতদিন বাঁচব এই আগুনের সঙ্গে আছি, থাকব। বুদ্ধদেব বসু তো কবেই বলেছেন, "লিটল ম্যাগাজিন মন জোগাতে আসেনি, মনকে জাগাতে এসেছে। " আমরা এই তত্ত্বেই বিশ্বাসী থাকতে চাই।

     এখন আনন্দ হয় যখন সেদিনের কথা ভাবি, লিটল ম্যাগাজিন  টেবিল থেকে লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত অবগুণ্ঠন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন,  তখন মনে হয় যেন পুরস্কার পেয়ে গেলাম। সে কী আনন্দ হয়েছিল আমাদের!  আনন্দ হয়েছিল যখন শুনেছিলাম দেবেশ কুমার আচার্য   কিংবা তপনকুমার চট্টোপাধ্যায়ের "বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত" বইতে গত পঞ্চাশ বছরে সাময়িক পত্রের ইতিহাস আলোচনায় অবগুণ্ঠনের কথা আছে দেখে। মনে হয় তাহলে সবটা বৃথা যায়নি। কিছুমাত্র দাগ হয়ত রাখতে পেরেছি, তা সে যত সামান্যই হোক।

(২০১৩ সালের ৩২ তম সংখ্যা)


     

Comments

২৭ বছর পেরিয়ে আমরা তরুণতররা লিখতে এসেছি।জানতে ইচ্ছে হতো যে পত্রিকায় এখন লিখি,তার ইতিবৃত্ত।কেমন ছিল সেই সূচনাপর্বের দিনগুলি।আজ অনেকটাই জানলাম।ভালো লাগছে এই ভেবে যে এই কদিনে আমিও এর অংশ হয়ে গেছি।কোথাও তেমন লেখা পাঠাতে ইচ্ছে করে না।ফলে পাঠাইও না।তবে অমিতাভদা ব্যতিক্রম। তাঁর ভালোবাসার ডাক এড়াতে পারি না।অবগুণ্ঠনের আরও অনেক শীর্ষ ছোঁয়ার মুহূর্তের সাক্ষী হতে চাই।
rkgclass said…
চমৎকার, সৎ বয়ান। মূল্যবান হাবড়া-অশোকনগর পরিপ্রেক্ষিতে।
লেখায় বানানো ছদ্ম দর্শন নেই, আছে বাস্তব চলার পথের রূপরেখা।
আমার ভারি প্রিয় এই পত্রিকার আটপৌরে গড়ন, পত্রিকার মেজাজ। অমিতাভর নিজের লেখা আর স্কেচ নিয়ে অনন্য। আমরাও দু'একবার লিখেছি, বনভোজনের যে খোলামেলা আনন্দ তা পেয়েছি। এখন অধিক নয়, জাপানি ছবির মতো সামান্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবার সময়।

আরও পড়ুন

একটি কবিতা সিরিজ

উপসংহার থেকে ফিরছি —কবিতা সিরিজ

একটি কবিতা সিরিজ

সাহিত্য বাজারের হাতে বাংলা ভাষাটার অবস্থা বড়ই করুণ----দীপ শেখর চক্রবর্তী

তিরিশের যুবক, জন্মদিন ও চিয়ার্স— কবিতা সিরিজ

বি শে ষ সা ক্ষা ত কা র : শ্রী সন্দীপ দত্ত

ছোট গল্পগুলি

জুজুতন্ত্রের সমূহ শ্বাপদ এবং হুজ্জতি

সাম্য রাইয়ান— নির্বাচিত একক সংখ্যা

সম্পর্কগাছ— কবিতা সিরিজ