প্রসঙ্গে, কবি সুবিমল মিশ্র





প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা আসলে একটি অনন্ত লড়াই। সেই লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি সফল তিনিই যিনি আজীবন এই যাপনেই বিশ্বাস ও শেষ পর্যন্ত আস্থা রাখেন। এক অপ্রত্যাশিত আবেদন যখন মোবাইল স্ক্রিনে এলো এবং যার বিষয় শুধুমাত্র ' লিটল ম্যাগাজিনের কবি ' , একথায় খুব ছোট ভাবেও শোনালেও আদৌতে যে এটাই আসল পরিচয় তা আর বলার উপেক্ষা রাখেনা। আজকের বেশ কিছু আলোচনা হতে পারে আমাদের চোখে কোথাও অসংগতি আবার হতেও পারে কোথাও ধরে পড়বে সম্পূর্ন অসংগতি,তবুও আমরা যে আলোচনায় শুনি বা অংশ গ্রহণ করি,যেন যৌক্তিকতার ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠা হয়



                                  কলকাতা বইমেলা ২০১০

এই কথা লিখতে লিখতে প্রথমেই আমার একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে,তবে পুরো কবিতাটা এই মুহূর্তে মনে পরছে না,দু লাইন স্পষ্ট মনে আছে --
" মহা সম্ভাবনাময় যে বিপ্লব
আমি তার আত্মীয়তা চাই " -(মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই যে বিপ্লব সেই বিপ্লবের রূপ বা সেই বিপ্লবের আকার কী? সেই বিপ্লবের নির্যাস কী? আর সবচেয়ে বড় কথা কীসের জন্য এই বিপ্লব ? মার্ক্সবাদী চিন্তা ও মতাদর্শে বিশ্বাসী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের অস্তিত্বের লড়াইকে বার বার বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু বার বার বিরোধিতা করেও তিনি জীবনের লড়াই যে কী ভয়ানক ও নিদারুণ ভাবে মানুষের ললাট রচনা করে,সেই কাহিনী আমাদের বার বার বলেছেন। এই যে এতো জীবনের কাছে মানুষের জীবন - আত্মা - অস্তিত্ব এবং এরই পাশাপাশি মানুষের প্রেম - আকাঙ্খার আর্তি নিয়ে বয়ে চলা মানুষের জয়গান গায়ছেন,এই চিন্তায় তো তাঁর সর্বশক্তিমানের বিপরীতের বার বার আত্মপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার প্রয়াস। আমরা সেই ছোট বেলায় ইতিহাসের পাতায় শিল্প বিপ্লবের কথা পড়েছি,জেনেছি। জেনেছি আমাদের ভারতবর্ষের সবুজ বিপ্লব,তাহলে আমাদের সমকালীন চিন্তায়, কথায়,ভাবনায়,লেখায় বিপ্লবের যে অবস্থান এবং বিপ্লবে যুক্ত বিপ্লবীদের আইডিওলোজি দুটোই কিন্তু এক নয়। তাহলে বিপ্লবের সংজ্ঞা কী? আমি আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বলব আসলে বিপ্লব এখন একটা প্রতিষ্ঠান। একটু গোটা করে বললে বলব, একটা বহুত্ববাদী ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে, সার্বিক বিরাট জন সমর্থনের ভিত্তির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুকরণের ওপর এক সদা ও সর্বদা বিরোধিতা এবং বিরোধিতা করতে করতে শেষ পর্যন্ত নিজের চিন্তার ওপর আস্থা ও ভরসা রাখা,এবং ক্রমাগত সাধারণ মানুষ বা সাধারণের স্বার্থের পক্ষেই সওয়াল করতে করতে নতুন এক জনমত এবং নতুন এক সমাজপরিবর্তনের দিক তৈরি করে দেওয়া,এই ঘটনার নির্জাস হল এক বিপরীত পন্থী বা ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠা করে দেয়া।

রবীন্দ্র সমসাময়িক একটি বড় বিরোধী প্রতিষ্ঠান কল্লোল যুগ আমরা অনেকেই জেনেছি। এর বিরোধিতা কীসের জন্য ছিল,অনেকেই জানেন। কিন্তু অনেকেই আবার এর মূলটা জানেন না। রবীন্দ্র বিরোধিতা করে একটা সহমত, একটা অবস্থান,একটা মত সারা রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরোধিতা করেছেন ঠিকই,কিন্ত কেউই এই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বেরোতে পারেননি। আসলে আমরা বিরোধিতা মানেই বিপ্লব বুঝে যাই,ফলে ঠিক কোন দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আমরা প্রতিষ্ঠানের বা শাসনের বিরোধিতা করব সেটা খুব স্পষ্ট হাওয়া দরকার। আজকের সময় ভার্চুয়াল বিপ্লব খুবই সহজাস্ত হয়েছে,ফলে বিপ্লবীদের জীবন যাপন, কাজের লড়াই, কাজের ধরণ,মোটিভ সবকিছুই উল্টে পাল্টে যাচ্ছে, যার কারণ এই সময়ের প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার একটি সার্বিক মনোভাব। বাংলা সাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিনের অবস্থান আজকের ১০০ বছরের আগের অবস্থায় নেই। সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে,সময় থেকে সমাজের ধর্মীয় - রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা। আজকের নিউক্লিয়ার পরিবার চিন্তা থেকে শুরু করে বিরাট বিশ্বজুড়ে বিরোধীতার একটা স্বর বা ঝড় তোলার যে রেয়াজ,সেটা কিন্তু কখনও সময় প্রকৃত অর্থে বিরোধী ভাবনা নয়। তাহলে বিরোধিতা কী? এমনকি এই সারা বাংলা সাহিত্যে প্রাতিষ্ঠানিকসাহিত্য বিরোধিতার বিরুদ্ধে একটি ইতিহাসক্রমে তৈরি হয়ে আসা স্বর - তৈরি হয়ে আসা সাহিত্য - তৈরি হয়ে আসা সাহিত্য চিন্তা ও চর্চার ফল হিসেবেই কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন এর সূচনা বা লিটল ম্যাগাজিনের পথ চলা শুরু। সারা বাংলা সাহিত্যে ক্রমাগত বিরোধিতা এবং স্ব-বিরোধিতা হয়েছে,কিন্তু সব ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিকতা বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বিরুদ্ধ স্বর। এই বিরুদ্ধতার স্বরই সাহিত্যে লিটল আখ্যা পেয়েছে। তৈরি হয়েছে পত্রিকা আর পত্রিকাকে কেন্দ্র করে পত্রিকা গোষ্ঠী। মত এবং মতাদর্শ। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে মনেকরি লিটল ম্যাগাজিন কোনো ট্রেন্ড সৈনিক নয়,যে কুচকাওয়াজে অংশ নেবে, কোনো স্টাইল নেই যে একটা নির্দিষ্ট রীতি মেনে চলবে - আমার কাছে এই লিটল ম্যাগাজিন একটি বৈপ্লবিক চিন্তা বা বিপরীতে মেরুতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করা অভিন্ন নিয়ম নীতি।



পেছনে বাম দিক থেকে : মৌলিনাথ বিশ্বাস, লালা, তাপস ঘোষ। সামনে বাঁ দিক থেকে : সুবিমল বসাক, মোহম্মদ খসরু, সুবিমল মিশ্র।

এবারে যে কথাটি নিয়ে আজকের মূল আলোচনায় আসব,সেটা হলো একজন লিটল ম্যাগাজিনের কবি মানেই কি সে ছোট কবি? নাকি সে সাধারণ কবি? এই প্রশ্নগুলো স্বাভাবিকভাবেই আমাদের অনেকের কানে ঘোরাফেরা করে। একজন লেখক বা একজন কবির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তিনি কোথায় লিখবেন ? অর্থাৎ তিনি বড় কাগজে লিখবেন আবার ছোট কাগজেও লিখেবেন। এই দেখুন বিস্তারিত আলোচনায় অদ্ভুতভাবে কোথায় একটা গণ্ডি কেটে দিলাম ছোট ও বড় কাগজ বলে। আসলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একজন লেখক কোথাও তাঁর একটি আইডিওলোজি নিয়েই সমাজ সভ্যতায় নিজের অবস্থান নির্ণয় করেন। হতে পারে এই নির্ণয় একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত এবং এও হতে পারে পারিপার্শ্বিকতা বজায় রাখার তাগিদ ক্রমাগত তাঁকে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের পাশে থেকে অথবা মধ্যে অবস্থান করে ক্রমাগত সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁর আনুগত্য পোষণ। আমরা একথা বলতেই পারি রমেন্দ্র কুমার আচার্যচৌধুরী যিনি শুধুমাত্রই লিটল ম্যাগাজিনের জন্য হেঁটেছেন। আরও এক প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ব সুবিমল মিশ্র। তবে আমি এক্ষেত্রে সুবিমল মিশ্রকে নিয়েই কিছু আলোচনা টানব। একাধারে ছোট পত্রিকায় তাঁর দীর্ঘ চার থেকে পঞ্চাশ দশক ধরে লিখে যাওয়া,এটা কম সহজ কাজ নয়। এই স্থিরতা সাধারণত কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে এতো নিষ্ঠাকারে দেখা যায় না। আসলে সুবিমল মিশ্র নিজেই এক প্রতিষ্ঠান ছিলেন, একথা জোর দিয়ে বলতে পারি এই কারণে যে,একজন লেখক যখন তাঁর শিল্প বোধ দিয়ে সাহিত্য চর্চা করেন এবং তিনিই যখন দার্শনিকচিন্তায় নিজের আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারেন,তখন কোনরকম প্রথা বা আচারসিদ্ধতা তাঁর ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় না। সুবিমল মিশ্রের নিজের ও পাঠকদের ভাষায় তার লেখা ছোটগল্পগুলো অ্যান্টি-গল্প এবং উপন্যাসকে অ্যান্টি উপন্যাস বলা হয়। তাঁর যে ছোটগল্পটি বাংলা সাহিত্যজগতে প্রথম আলোড়ন ফেলে সেটি হল ৬৭ সালে প্রকাশিত 'হারান মাঝির বিধবা বৌ এর মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি'। এই গল্পটি আবার ইংরেজিতেও অনূদিত হয়। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখাতেই রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্লেষন ও মধ্যবিত্ত সমাজের যৌনতা নিয়ে অচ্ছুতপনার বিরুদ্ধে জেহাদ লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, তার শোষন, সুবিধাভোগী শ্রেনীর প্রতি ব্যঙ্গ, অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব, লেখার কোলাজ এবং বিশেষভাবে নৈরাজ্য ইত্যাদি সুবিমলের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাণিজ্যিক পত্রিকাতে তিনি কখনো লেখেননি, তাদের প্রতি সুবিমল কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকেন এবং তার সাহিত্যকর্ম দুই বাংলার মননশীল লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ও সমাদৃত হয়েছে একাধিকবার।সেই গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ ছিল টিকে থাকা, টিকিয়ে রাখাকে অস্বীকার করার সময়। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা যেমন সত্য হয়েছে, সাহিত্যেও। দুটি সাহিত্য আন্দোলন, ক্ষুধার্ত প্রজন্ম আর শাস্ত্রবিরোধী, এই দুই আন্দোলনের বাইরে থেকে একা সুবিমল মিশ্র ভেঙে দিয়েছেন গল্পের প্রচলিত লিখন প্রক্রিয়া। আর হ্যাঁ, বিরোধিতার প্রচলিত ছকও। আর এই কাজের জন্য সবচেয়ে জরুরি যে ক্ষেত্র সেটা হল প্ল্যাটফর্ম অর্থাৎ কোথায় তিনি একথা বলবেন ! বা কীভাবে তিনি একথা বলবেন ! এবং হয়তো সেই কারণেই তাঁর একমাত্র হাতিয়ার হয়েছে লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট পত্রিকা। যদিও এই লিটল ম্যাগাজিন চিন্তা বা ধরণ বা ট্যাকটিস এগুলো কোনো কিছুই আর একই নিয়মের বেড়াজালে নেই। এগুলো এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কোনো কিছুর প্রতি শেষ আস্থা থাকাটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে,তাই আজকের এই অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গী, সমাজের প্রতি তাঁর মূল্যবোধ বা দায়বদ্ধতা পরিবর্তিত হাওয়া স্বাভাবিক,আর এই পর্বে টিকেই কিন্তু তিনি একক আসনে যেন সংখ্যা গরিষ্ঠতায় জয়ী হয়েছেন। সমাজের যে ঘটনা খুব সোজা করেই বলা যায়,সেই কথায় সুবিমল বলেছেন,সোজা করেই, ভণিতা ছাড়ায়।

সুবিমল মিশ্রের মধ্যে ভনিতা নেই। তিনি সরাসরি বলতে চান। সেই ভদ্রমহিলার মতো। স্বামী যাকে জোছনারাতে রোমান্টিক পরিবেশে ভূমিকাস্বরূপ বলেছিলেন, আজ কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে, দেখেছো? তখন ভদ্রমহিলা ঝামটা মেরে ওঠলেন, আসল কথা বললেই তো পারো যে তুমি আমাকে নিয়ে এখন শুতে চাও! চাঁদ নিয়া টানাটানির দরকার কী। সুবিমল মিশ্রও ওসব চাঁদকথার দিকে যেতে চান না। তার গল্পবলা সরাসরি শুরু হয়ে যায়। ‘জ্যৈষ্ঠ মাসের এক শনিবার দুপুরে টালিগঞ্জের চার নম্বর বাস টার্মিনাল থেকে একটা বাস ছাড়ছে। বাসটির সবগুলো সিটেই লোক বসে আছে, শুধু সামনের দিকের একটা দুওলা সিটের কোণে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক, অন্য সিটটি খালি। ভদ্রলোকের দু’একটি চুল পাকা, বাড়িতে কাচানো সাদা লংক্লথের পাঞ্জাবিতে নীলের ভাগ বেশি পড়াতে একটা নীল আভা ফুটে রয়েছে।’

এই যে, যে মাঝবয়সী ভদ্রলোক, সে একজন দুর্বল মানুষ, তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে গল্প, কিন্তু তাকে আমার প্রধান চরিত্র বা নায়ক বলার রুচি হচ্ছে না। কেননা, আমিও তো এ-সমাজের একজন। সবল আর ক্ষমতাবানের দলে থাকতে ভালোবাসি। আমি তাই এই গল্পের নায়ক বলতে ওই তিন যুবককেই নেব। যারা একটু পরই যখন বাসটা ছেড়ে দিল, তার আগে আগে বাসে চড়ে বসলো। এবং বাসে চড়ে যেহেতু তারা তিনজন জোটবদ্ধ, কাউকে ফেলে কেউ একা বসতে পারে না, একজনের জন্য আরেকজনের সহমর্মিতা হয় এবং অনুভূতি কাজ করে, তাই তারা সেই দুর্বলের পাশে খালি-থাকা মাত্র একজনের জন্য বাসের সিটটায় তিনজনই একসঙ্গে বসতে চাইল এবং বসেই গেল।
ওরা একজনের সিটে এই তিনজন বসার ধৃষ্টতা বা সাহস যাই বলি না কেন, সেটা কোথা থেকে পেল জানেন? মূলত মাঝবয়সী ভদ্রলোকটির গায়ের ওই পাঞ্জাবির কাছ থেকে, যাতে নীলের ভাগ বেশি পড়াতে তার একটা আভা ফুটে রয়েছে এবং এ-বর্ণনার কারণে পাঠকেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দুর্বল মানুষটি সমাজের কোন্ স্তরে অবস্থান করছে। ফলে, তার পাশের খালি সিটে একজনের জায়গায় দুজন কেন, তিনজনও অনায়াসে বসা যায়। এবং যুবক তিনজন তাই-ই বসেছে, যেহেতু যুবক তিনজন জানে যে, ভদ্রলোক সংখ্যায় একা এবং সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ আর ওরা সংখ্যায় তিনজন এবং সমাজে ওদের একটা ডাটফাট অবস্থান রয়েছে, শারীরিক শক্তিতেও এগিয়ে। তাই বাসের যারা সাধারণ যাত্রী, তারা সবাই ওদের তিনজনের পক্ষেই দাঁড়াবে। অথবা দেখেও কিছুই দেখেনি এমন একটা না দেখার ভাব করবে। এবং বাসের যে কর্তৃপক্ষ ও ড্রাইভার কন্ডাক্টর বা হেলপার ওরাও তিনজন যুবকের পক্ষেই এগিয়ে আসবে। আদতে হয়ও তাই। সেটাই যে দগদগে বাস্তবতা!
আমি যেহেতু এ-সমাজেরই মানুষ, আমি এই গল্পের দুর্বল মানুষটি শেষাবধি যে পরিণতির শিকার হলো, তার জন্য ওকেই দায়ী করবো। দুজনের সিটে যখন চারজন বসা হলো এবং দুর্বল মারাত্মক রকমের কোনঠাসা হয়ে গেল, ওর তো তখন উচিত ছিল চুপচাপ সে-যাতনাই সয়ে যাওয়া! দুর্বল মানুষ পৃথিবীতে এসেছেই তো যাতনা পেতে! যত যাতনা যত অবহেলা অপমান গঞ্জনা- সবই সে মুখ বুঁজে সহ্য করবে। এটাই তো নিয়ম। কেন সে হঠাৎ একটু অধৈর্য হয়ে বিরক্তি মেশানো কন্ঠে বলতে গেল, কি হচ্ছে? তাতেই তো গায়ে তাত লাগলো যুবকত্রয়ের, কিছু না একটু বসতে যাচ্ছি আর কি!
ভদ্রলোক এই ভাবে বসে?

এখানে এসেই গল্পকার কোনোভাবে আরোপিত নয়, ন্যাচারালভাবেই সমাজের গালে কষে একটা থাপ্পড় মারলেন। মোটা দাগে নয়,সূক্ষ্ম আঁচড়ে। আমাদের এ-সমাজে, চোখের সামনে একজন হাইজ্যাকার বুকে ছুরি মেরে সর্বস্ব নিয়ে গেলেও কেউ এগিয়ে আসে না। বাস থেকে হেলপার একজন যাত্রীকে ফেলে মেরে দিলেও কারো প্রতিক্রিয়া হয় না। শ শ লোকের সামনে রিফাত শরীফকে নির্বিঘ্নে হত্যা করে সবল-নির্মিত বন্ড। সুবিমল মিশ্রের গল্পেও সমাজের লোকদের সে-চেহারাটাই পাওয়া গেল। অথচ কেউ একজনও যদি তিন যুবকের আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত, মাঝবয়সী ভদ্রলোককে হয়তো এতটা অপমান সহ্য করতে হতো না। বরঞ্চ সবার এই নিস্পৃহতা যুবকত্রয়কে আরো বেশি দুবির্নীত করে তোলে। দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়সী ভদ্রলোক যখন বিদ্রুপের গান অবশেষে আর সহ্য করতে না পেরে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, তোমাদের বাবাকে শুনিয়ো এই গান, বুঝেছো- তোমাদের বাবাকে শুনিয়ো। তখন ওরা তিনজন আরো বন্য হয়ে উঠল, ‘বাবা তুলেছে- একজন ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। ভদ্রলোকটির পাঞ্জাবি খামচে ধরে: এতক্ষণ সহ্য করেছি আর করবো না- উইড্র করুন। অন্য দুজনও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারাও বললো: উইড্র করুন। না হলে ছাড়ছি না- উইড্র করুন।
আসলে আমরা যেভাবে অন্ধকার দেখলে পেছনে হাঁটি,সুবিমল মিশ্র সেই রাস্তায় হাঁটেন না,তাই তিনি সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানেরও যেন এক বিপরীতে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দেন -- তিনি নিজেই যেন একটা শাসন। এই শাসনের মধ্যে দিয়েই তিনি প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন,পেন ধরতে পারেন।
একটু অন্য একটা কথা বলে ফেলি আবারও এখানে(সম্প্রতি একটি পত্রিকায় একটা লেখায় এই উদাহরণ টেনে ছিলাম। এখানে একটু বলছি সে কথা)
শঙ্খ ঘোষের একটি বই কবির বর্ম। বেশ কিছু কথা। তাঁর নানান আলোচনা এবং সেই বইটিতে আলোচিত বেশ কিছু ঘটনা। এক জাগায় এক ঘটনার কথা লিখছেন -
" স্বাধীনতা পরবর্তী পাঁচ বছরের সাহিত্যচর্চা নিয়ে কয়েকদিনের এক আলোচনাসভা বসেছিল শান্তিনিকেতনে, ১৯৫৩ সালের বসন্তে। কবিতার কথা বলতে গিয়ে সেই সভায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'কিন্তু সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকেও যিনি কিছুর মধ্যেই নন, সেই ভাবান্তরহীন কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ।' এই মন্তব্য দিয়ে শুরু করে জীবনানন্দ বিষয়ে যে বিচার তিনি দিয়েছিলেন সেদিন, তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাঁর ধিক্কার আর প্রত্যাখ্যান। জীবনানন্দের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল এই যে তিনি শুধু তাসের ঘর সাজান, সময়ের কণ্ঠরোধ করে কথা বলেন তিনি। শব্দ তার কাছে বস্তুবিরহিত সংকেত মাত্র'। কথাগুলি শেষ করবার পর মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন যখন, প্রত্যক্ষ দর্শক আর শ্রোতা হিসেবে আমাদের কারও কারও মনে আছে, বুদ্ধদেব বসু ঝাঁপ দিয়ে উঠলেন এর প্রতিবাদের জন্য। মনে আছে, সিঁড়িতে পা রেখে নিবিষ্ট দাঁড়িয়ে আছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শুনে নিচ্ছেন প্রতিবাদ, শুনছেন বুদ্ধদেবের বক্তৃতাশেষে এই তর্জনময় অথচ সস্নেহ নির্দেশ : "সুভাষ, পরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।”

সেদিনই যে তাঁদের দেখা হয়েছিল, তা জানি। কিন্তু সেই দেখায় আর কথায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতির কি কোনও বদল হয়েছিল? অন্তত এই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই ‘পরিচয়' পত্রিকায় আমাদের তো পড়তে হলো তাঁর কয়েক পৃষ্ঠা লেখা, 'নির্জনতম কবি সে-লেখার নাম, আক্রমণের ঝাঁঝ আরও তীব্র হলো যে লেখায়। জীবনানন্দের মৃত্যুর মাত্র একবছর আগে, সে লেখায় আমরা জানলাম যে দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী দুটি দশক বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায় তাঁর কবিতায়, জানলাম যে তিনি শুধু 'নিরালম্ব শূন্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে'দেখান, 'প্রত্যেকের মুখে তিনি এঁটে দেন কুয়াশার একই মুখোশ', তাঁর কবিতায় থাকে শুধু ‘ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে' মৃত্যুর জন্য ‘নতমস্তকে’ অপেক্ষা করা। আমরা শুনি যে জীবনানন্দের কবিতা ভরে আছে শুধু ‘মানুষের প্রতি তাঁর নিদারুণ বিদ্বেষ, পৃথিবীর প্রতি তাঁর উদ্ধত অবজ্ঞায়', এর অনেক উদাহরণের মধ্যে প্রকট হয়ে থাকে 'অন্ধকার' কবিতাটির উদ্ধৃত কয়েকটি লাইন, যেখানে কবি শত শত শূকরের চিৎকারে শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বরের কথা বলতে চেয়েছিলেন।
তখনও, এবং আজও, এই লেখা বেশ গুরুত্ব পায় কেবল এজন্য নয় যে একজন কবির বিষয়ে আরেকজন কবিই কথা বলছেন এখানে; এ-লেখার আরও একটা স্মরণীয়তা এইজন্য যে সমকালীন বড়ো একজন কবির বিষয়ে একটা মার্ক্সবাদী বিচারের চিহ্ন রয়ে গেল এখানে। ওপরে বলা ওই মন্তব্যগুলি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত মত মাত্র নয়, এমনকী এতটাও বলা যায় যে ব্যক্তিগতভাবে এ হয়তো তাঁর মতই নয়, এর মধ্যে একটা সংঘগত দৃষ্টি কাজ করছিল সেদিন। "... এই ঘটনার একটি মূল দিক,যা হল এক কবির শিল্প দৃষ্টির বিপরীতে দ্বিতীয় কবির দৃষ্টিভঙ্গি বা যুক্তি এবং বিরোধী বক্তব্য। আসলে প্রতিবাদী স্বরের বিপরীত এক অঅনুকরণ পন্থা এবং যা সর্বাংশে সত্য ও যুক্তিপূর্ণ। আবার বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে খুব সাধারণ ও সহজ সরল এমনকি বাস্তবতার মূর্ততা নিয়েই তো একজন শিল্পী ছবি আঁকবেন,কবি কবিতা লিখবেন,পরিচালক সিনেমা বানাবেন।আসলে এই বিপরীতে দাঁড়িয়ে যেন খুব সহজে গায়ের ঘা গুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জ্বালা জুরোনোর পালা তৈরি হয়।আমরা সাধারণ পাঠক তা থেকেই নির্যাস তুলতে পারি স্বাচ্ছন্দ্যে।


                    কবি সুবিমল মিশ্র কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে

শেষে আসল কথা হল,এই যে আমরা কীভাবে বিভাজনের দিকে হাঁটব ? কীভাবে আমরা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী বা স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠানের কথা বলব। আমাদের যেখানে প্রতিষ্ঠানের জনই হয়তো মুখিয়ে আছি। সুবিমল মিশ্র নিজেই তো প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে থেকেছেন জীবদ্দশা পর্যন্ত। কমল কুমার মজুমদার, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় -- এঁরা কি সকলেই আনন্দ কোম্পানিতে লিখেছেন ? এও বলেছেন গদ্য সাহিত্যে দেবেশ রায় বা উদয়ন ঘোষ কোনোদিন কোনো কালে শারদীয় দেশ পত্রিকায় লিখেছেন বলে দেখিনি।আসলে তাদের কাজ ছিল প্রথাসর্বস্ব বিরোধিতা করে পাঠকের কাছে নির্যাস টুকু তুলে দেওয়া। কাহিনী বা সাহিত্যের চোরাগোপ্তা বা একপ্রকার ছলনা না করেও পাঠকের কাছে অনেক প্রিয় হওয়া যায় অর্থাৎ পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়।
সুবিমল মিশ্র গল্পকে ভেঙেছেন যেমন, আবার পরিপূর্ণ কাহিনিও লিখেছেন। তিনি কোনও একটি আঙ্গিকে স্থিত হননি। যে লেখক জানেন নির্মাণ, তিনিই তো ভাঙতে পারেন। তিনি অসম্ভব আক্রমণাত্মক। তিনি বলছেন, ‘প্রতিষ্ঠিত শক্তিই প্রতিষ্ঠান। তার চরিত্র হল জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে তোলা নয়, দাবিয়ে রাখা। যে কোনও স্বাধীন অভিব্যক্তির মুখ চেপে বন্ধ করা, তা অবশ্যই শ্রেণি স্বার্থে।’ সুবিমল বড় কাগজের বিপরীতে ছোট কাগজের কথা বলেছেন। তাঁর সমস্ত জীবনের লেখালেখি নিয়ে অবশ্যই তা মান্য। হ্যাঁ, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আমাদের কাছে সাহিত্যের এক নতুন পরিসর উন্মুক্ত করেছে নিশ্চয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাঁর মন্তব্য নিয়ে বিরোধিতার জায়গা আছে। তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। পাঠক বুঝতে চাইবেন, একমত হবেন কিংবা হবেন না কোনও কোনও সিদ্ধান্তে। অনেক জায়গায় একমত না হলেও সুবিমলকে সহ্য করতে হবে বহু সময় ধরে। তাঁর গদ্য তীক্ষ্ণ ফলার মতো। তাই আমরা একজন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক হিসেবে সুবিমল মিশ্রকে নিয়ে আলোচনা করতেই পারি। লিটল ম্যাগাজিনের কবি হয়েও তিনি পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন নির্দ্বিধায়, প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে থেকে তিনি অন্ধকারের হেঁটেছেন এমন নয়,বরঞ্চ স্ব বিরোধিতা রেখেই যেন এক বৃহত্তর পাঠকের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন আমৃত্যু। তাই আজকের ইন্টারনেটের যুগে যেখানে আমরা সদা স্মার্ট ফোনের যুগে কথা বলি, ছবি আঁকি, ভাষণ দিচ্ছি, সিনেমা বানাচ্ছি, রিল থেকে মিম, জিও কানেকশন ছেড়ে ডিজনী চ্যানেলে দেখছি কোটি কোটি টাকার আই.পি.এল থেকে শাসকের তৈরি একের পর এক ঘটনা,তবুও আমরা কোথাও হারিয়ে গেছি বিনোদনের দুনিয়ায়। আমরা যেভাবে সর্বদা নিজেদের জুড়িয়েছি সোশ্যাল মিডিয়ার শো'য়ে। সেখানে সুবিমল মিশ্রের মতো ব্যক্তিত্বরা আমাদের স্পৃহা ছাড়া কিছুই না। তাই লিটল ম্যাগাজিনের লেখক মানেই যে শুধুমাত্র কতিপয় লেখা বা অল্প পরিচিতি বা নির্বাসনের কবি - লেখক, তা কিন্তু একে বারেই নয়।



তথ্যসূত্র :
১) সুবিমল গদ্য সংগ্রহ ১, সুবিমল গদ্য সংগ্রহ -২,সুবিমল গদ্য সংগ্রহ -৩ সুবিমল গদ্য সংগ্রহ -৪ (গাংচিল)
২) কবিতা সংকলন (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় - পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি)
৩) কবির বর্ম (শঙ্খ ঘোষ - সপ্তর্ষি প্রকাশনা)
৪) বোবা যুদ্ধ ( জানুয়ারি ৯১)
৫) খোলা কাগজ (দৈনিক - জুলাই ২০১৯- বাংলাদেশ)
৬) আজতক (বাংলা - নিউজ )
৭) সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে ( সাম্য রাইয়ান - ঘাসফুল)

Comments

আরও পড়ুন

কবিতা সিরিজ

বি শে ষ সা ক্ষা ত কা র : শ্রী সন্দীপ দত্ত

কবিতা

কবিতা