বি শে ষ সা ক্ষা ত কা র : শ্রী সন্দীপ দত্ত
শ্রী সন্দীপ দত্ত এর মুখোমুখি সাহিত্যিক জয়িতা ভট্টাচার্য
জয়িতা : লিটল ম্যাগাজিনে লেখা ও পত্রিকা করা এটা সব সময়ই ছিলো এখন আরো বেশি করে সাহিত্যচর্চা বেড়েছে।কিন্তু বিভিন্ন দশকে বিভিন্ন জেলা ও শহর কলকাতা তথা বাংলা ভাষার লিটিল ম্যাগাজিনগুলি একত্রিত করার কথা সংরক্ষণ করার কথা কেবল আপনি ভেবেছেন। এই পরিকল্পনা কিভাবে এবং কবে আপনি ভেবেছিলেন?
সন্দীপ দা : সেটা বলা যায় একটা টার্নিং পয়েন্ট। তখন আমি স্কটিসে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ছি। পার্ট টু দেব।১৯৭২ সাল। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পড়াশোনা সূত্রে প্রায়ই যেতাম। মে মাসে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল। দেখলাম বাংলা বিভাগের সামনে বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন স্তুপের মতো জড়ো করা রয়েছে। তখন বাংলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন কবি নচিকেতা ভরদ্বাজ। কৌতূহলী হয়ে তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম এভাবে এইসব পত্রিকাগুলো পড়ে আছে কেন? উত্তরে তিনি বললেন এগুলো রাখা হবে না। তার কারণ অনিয়মিত বেরোয়। বাঁধাইয়ের অসুবিধা ইত্যাদি। পা থেকে মাথা জ্বলে উঠল। নিজে তখন 'পত্রপুট 'নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন করি। মনে হলো এ তো আমাকে অপমান।বাংলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিনকেই অপমান। ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে চলে এলাম। পার্ট টু পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার পর ঠিক করলাম ওই ঘটনার প্রতিবাদে লিটল ম্যাগাজিনের একটি প্রদর্শনী করবো। পাড়ার একটি ক্লাবের সহযোগিতায় ১৯৭২ সালের ২৩--২৭ সেপ্টেম্বর বাড়ির নিচে, একতলায় সদর আর বৈঠকখানায় ৭৫০লিটল ম্যাগাজিনের একটি প্রদর্শনী করি। সেই প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ পত্র, ছবি, মন্তব্যর খাতা আজও আমার কাছে সযত্নে আছে। লাইব্রেরি গড়ার নেপথ্যে এই সলতে পাকানোর ইতিহাসটিও উল্লেখযোগ্য।৬বছর পরে ১৯৭৮ এর ২৩ জুন লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা। না, কোনো আনুষ্ঠানিক ভাবে সূচনা হয়নি এই লাইব্রেরির। আমার ডায়রির পাতায় সবুজ কালি দিয়ে লেখা আছে "আজ থেকে শুরু করলাম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি বাংলা সাময়িক পত্র পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। উপেক্ষা, তচ্ছিল্য, অবমানানার ভ্রূণে এভাবেই জন্ম হলো বাংলাভাষার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির।
জয়িতা : লিটিল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা তৈরি করার ব্যাপারে আপনার প্রাথমিক দিনগুলোতে কাকে কাকে পাশে পেয়েছিলেন?
সন্দীপ দা : একক অভিযান। সংগ্রহর দিকেই মন দিয়েছিলাম বেশি। ছাত্র জীবন। সদ্য এম এ পাস করেছি। পত্র -পত্রিকা কেনার জন্যে ১৯৭৭এ সিগারেট খাওয়া ছাড়লাম। ওতে কোনো খাদ্যগুণ নেই, ওই পয়সায় লিটল ম্যাগাজিন কেনা যাবে। ওই বছরই মেদিনীপুরের রাধামোহনপুর বিবেকানন্দ হাইস্কুলে ১০০টাকার মাইনেতে পার্টটাইম শিক্ষাকতার চাকরি। রাতে একটা সংবাদপত্র অফিসে ৫০টাকার ট্রেনি।আর একটা পিগি ব্যাংক। লক্ষীর ভাঁড়। তাতে খুচরো ফেলি। এই পুঁজি দিয়েই সূচনা। তখন পাশে কোথায় কে!প্রথম ১৮বছর ব্যক্তিগত অর্থ ব্যায়ে লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। ফেসবুক ছিল না। নিয়মিত বিবলিওগ্রাফি নির্মাণ করে তবে পাঠকের কাছে পৌঁছেছি।
জয়িতা : যে কোনো কাজই করতে গেলে প্রথমে তার স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন এমনকি উপেক্ষাও সইতে হয়।সন্দীপদা আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
সন্দীপ দা : উপেক্ষা তাচ্ছিল্য তো ছিলই।১৯৮২ সালে বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড সুকুমার সেনের হাতে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে বিবলিওগ্রাপফি সংখ্যা দিতে উনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আমাকে ভর্তসনা করে বলেছিলেন, লিটল ম্যাগাজিন জঞ্জাল রাবিশ। আর আপনি তার তালিকা করছেন!কেউ আসত না লাইব্রেরিতে। ধৈর্য ধরে বসে থাকতাম।১৯৮১সালের ১৬ জুন আনন্দবাজারে কলকাতার করচায় প্রথম লাইব্রেরি নিয়ে লেখা হলো।
জয়িতা : আজ যেটি লিটিল ম্যাগাজিন দপ্তর একদম প্রথমদিনেও কি এখানেই ছিলো?যাত্রা শুরুর দিনগুলি কেমন ছিল?
সন্দীপ দা : লাইব্রেরি শুরু থেকে আজ একই অবস্থানে। খুব কষ্টের আর যন্ত্রণার অগ্নিপথে এই লাইব্রেরির গড়ে ওঠা। সিটি কলেজ স্কুলে আমি যোগ দিই ১৯৮১. স্কুলে যাওয়ার আগে ও স্কুল থেকে ফিরে লাইব্রেরি খুলতাম।১৫০০ লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে শুরু হলেও পত্রিকা আসতে লাগলো ডাকে। কিনতামও। ফলে পত্রিকার সংখ্যা বাড়তেই থাকলো। নিয়মিত বিবলিওগ্রাফ চলছিল। তখন পাঠকদের সে অর্থে কোনো সদস্যচাঁদা ছিল না।পুরানো বই পত্রিকা নিয়মিত কেনা, বাঁধাই,সেলফ কেনা এসব চলত।
জয়িতা : আজ লিটিল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা একটি বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার সাহিত্য ইতিহাসে যার একক কারিগর আপনি। আর্থিক সাহায্য ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন কি?
সন্দীপ দা : ১৯৯৬ সালে লাইব্রেরি রেজিস্ট্রি হয়। এখন সদস্য চাঁদায় লাইব্রেরি চলে। আসল সমস্যা জায়গার। তিনটি কক্ষে লাইব্রেরি অবস্থান করলেও আসলে অভাব স্পেস।
জয়িতা : কেবল প্রাচীন থেকে আধুনিক সাহিত্য পত্রিকা সংরক্ষণ ছাড়া আরও কীভাবে গবেষকদের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে আজ লিটিল ম্যাগাজিন গ্রন্থাগার ?
সন্দীপ দা : বিপুল গবেষণা মূলক বই এবং ইন্টারনেট অর্কইভ আছে।
জয়িতা : ভবিষ্যতে আর কী কী পরিকল্পনা আছে আপনার। অথবা কী হলে ভালো হয় বলে মনে করেন?
সন্দীপ দা : আগামী দিনে একটি সম্পূর্ণ কবিতার বইয়ের লাইব্রেরি খুলতে চলেছি দক্ষিণ কলকাতায়। ইচ্ছে হয় আন্তর্জাতিক করে তোলার। Space পেলেই এটা সম্ভব।
জয়িতা : কোথাও কি আপনার কিছুটা হতাশা বা ক্ষোভ আছে সন্দীপদা আপনার এই সুবৃহৎ কাজের সূত্রে?
সন্দীপ দা : আসলে আমি শুরু করেছিলাম শূন্য অবস্থান থেকে। তখন কেউ বুঝতে চায়নি লিটল ম্যাগাজিনের শক্তিকে, তার বিস্তারকে, তার চেতনাকে, তার লেখালেখির গুরুত্বকে। শুধু পত্রিকা বেরিয়েই গেছে।যখন লাইব্রেরি গড়ে উঠল প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর স্বপ্নমন্ত্রে তা আমাকে ভাবালো। কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে গেল। আড্ডা, সভা, বিনোদন, ভ্রমণ কফিহাউস সব হারিয়ে যেতে লাগল। না এতে কোনো ক্ষোভ নেই। আসলে যখন দেখি সরকার এগিয়ে আসে না আমাদের জায়গা দিতে, তখন সত্যি হতাশ হই। দমি না। লড়াইটা চালাতেই হয়।৪৫ বছর ধরে আঁকড়ে ধরে আছি ৯০হাজার লিটল ম্যাগাজিন সহ ৫০০০কবিতা গল্প প্রবন্ধের বই।
জয়িতা : কোনো বিশেষ প্রাপ্তি অথবা স্বীকৃতি পেয়েছেন সরকার থেকে?
সন্দীপ দা : ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো পুরস্কার বা সম্মান নিই না। সরকার আমাকে বা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিকে দেবেই বা কেন?
জয়িতা : নিজের লেখালিখি সম্পর্কে জানতে চাই।আপনি সেই ব্যাপারে সব সময়ই খুব আড়ালে রেখেছেন নিজেকে।
সন্দীপ দা : কবিতার বই আমার ৪টি। কোলাজ, ভুবনেশ্বরী, বহতা ও কবিতাভান্ড। লিটল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত বই ৫টি। প্রসঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিন ভাবনা, লিটল ম্যাগাজিন ভাবনায়, বিষয় যখন লিটল ম্যাগাজিন ও লিটল ম্যাগাজিন :এক স্বতন্ত্র অভিযাত্রা।কালপঞ্জি --বাংলা কবিতার কালপঞ্জি (১৯২৭-১৯৮৯), তারাশঙ্কর কালপঞ্জি, বিভূতিভূষণ কালপঞ্জি।
বিবাহ মঙ্গল, স্ল্যাংগুয়েজ,বাংলা গল্পকবিতা আন্দোলনের তিন দশক,কবিতাকাজ, বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিবৃত্ত ১ ও ২খন্ড। সম্পাদনা ---জীবনানন্দ প্রাসঙ্গিকী, গল্পের কোলাজ, লিটল ম্যাগাজিনে দেশভাগ, বাংলাভাষা, সুভাষ মুখোপাধ্যায় জীবন ও সাহিত্য।
পত্রিকা সম্পাদনা -হার্দ্য, পত্রপুট, উজ্জ্বল উদ্ধার, Little Magazine News and Views.
জয়িতা : লিটিল ম্যাগাজিন ও তার গবেষণায় সন্দীপ দত্তর নাম আজ অনিবার্য ও ঐতিহাসিক। আপনার নিজস্ব উপলব্ধি ও পরিতৃপ্তি এই ব্যাপারে কেমন?
সন্দীপ দা : কাজ করে চলাই একমাত্র কাজ
জয়িতা : কোনো প্রিয় স্বপ্নের কথা বলুন পত্রিকার তরফ থেকে ও আমার প্রণাম, শ্রদ্ধা ও সতত শুভকামনা রইল সন্দীপদা আপনার লিটিল ম্যাগাজিন গ্রন্থাগার আরো ছড়িয়ে পড়ুক বিকেন্দ্রীত হোক?
সন্দীপ দা : স্বপ্ন কাজের পাসপোর্ট। স্বপ্ন দেখি এক আন্তর্জাতিক লিটল ম্যাগাজিন ভবনের।
Comments