ঝুলন্ত উইন্ড চাইম...

 

Misha Gordin's Photographic Collection

ট্রামলাইনের ধার দিয়ে সচেতনভাবে যেতে হয়-- জীবন দিয়ে সচেতন করে দিয়ে গেছেন একজন।

ট্রামলাইন ধরে এগোতে এগোতেই হঠাৎ পেছন থেকে আসা একটা শব্দে সচেতন হয়ে গেলাম। ট্রাম না, হাতে টানা রিকশার ঘন্টি। এভাবে সচেতনতা এসে হঠাৎ কলার ধরলেই কবির মুখ মনে পড়ে যায়। কাব্য না, শুধু কবির মুখ। বাস বা অন্য কোনো যানবাহনের সামনে এসে পড়লে না... শুধু ট্রামের ক্ষেত্রেই। কোনো প্রকার অ্যালগোরিদম হয়ে আছে মাথার ভেতর। অবশ্য, মাঝে মাঝে রেল লাইন পার হওয়ার সময়েও মনে পড়ে। নিয়ম না মেনে প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে সরাসরি লাইন পার করে যাওয়ার সময়ে। সবাই দুদিক দেখেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে পার হয়। ট্রেন তো ভূত না যে হঠাৎ উদয় হবে! রাণা দা কি সচেতন ছিলেন না সেদিন তাহলে?... অন্য কারো কথা ভাবছিলেন... কবির মতো?
আনমনে এগোতে এগোতে কখন রুটি-তরকারির দোকানের ফাঁক দিয়ে ফুটপাথে উঠে যাই, কখন নেমে যাই আবার রাস্তায়-- খেয়াল থাকে না। চেনা পথের একটা নিজস্ব রিপিট-মোড অ্যালগোরিদম থাকে বোধহয়। মাথা নিজের মতো চালিয়ে নেয় পা-দের। মাঝে মাঝে কাঁধে ধাক্কা লাগে। প্রতিটা ধাক্কা যতিচিহ্নের মতো। কিছু যতিচিহ্ন দীর্ঘ হয়।

কাছাকাছি সশব্দে বাজি পুড়লে, শিশুর কান্না অথবা আর্তনাদ... কোনোটাই শোনা যায় না। আর এখন তো উচ্চমানের লাউড মিউজিক সিস্টেম পাড়ায় বসাতে দু মিনিট লাগে। কিছু কথা চেঁচিয়ে না বললে বোঝানো যায় না। অথচ সমবেত কোরাস কিছুতেই মিউজিক সিস্টেম অথবা বাজি পোড়ানোর তীব্র নয়েজকে ছাপিয়ে উঠতে পারছে না। অথবা, একপ্রকার রেগুলেটর দিয়ে ব্যবস্থা করাই আছে এমন-- কোরাসের স্বর যত ওপরে উঠবে, তত লাউড হবে ডিজের মিউজিক।

"There are patterns within chaotic systems, even though they may appear random"
শব্দ আর পাল্টা শব্দের মাঝে পাশের মানুষটাকেও ঠিকঠাক বোঝাতে পারি না। অতি সাধারণ, সরল কথাটাও বোঝাতে পারি না। তার কথাও ঠিকঠাক বুঝতে পারি না।
একে অপরের লিপ রিড করার চেষ্টা করি। বিকল্প হিসেবে বেছে নিই 'লিখে জানানো'। লিখে পাঠাই, লিখে রাখি... আর অপেক্ষায় থাকি-- পড়ল? কী ভাবল পড়ে? বোঝাতে পারলাম কিছু আদৌ? ভুল বুঝল না তো?
ভুল বুঝে বুঝেই শেষ যাচ্ছে কত আমি। কত আমি ক্রমেই এক চলমান ভুল হয়ে যাচ্ছে।
এই যদি আমি এইটুকুই বলি-- আমি চাই চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকতে এক পাশে, আর তুমি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিও। যেভাবে কোনো বেড়াল অথবা কুকুর তোমার স্নেহ পায় কত সহজেই!
কী হাসির কথা... না?
কথায় কাজ না হলে পরের স্তরে উত্তরণ ঘটাতে হয়। তাকে বলে মুভমেন্ট। তাকে বলে আনরেস্ট।
মানুষ অনেক কিছু ভেবে নেয় এইসব শব্দের মুখোমুখি হলে।
অথচ আমি গভীর এবং তীব্র ভালোবাসার ভেতরে মুভমেন্ট এবং আনরেস্ট দেখেছি। শুধু কথায় কাজ হয় না...

দুপুরের পর থেকেই খালি মনে হচ্ছে, কেউ একজন একদিন chaos and existence প্রসঙ্গে বলতে বলতে হঠাৎ বলেছিল--
'দু কাপ চা খেতে খেতে অনেক কিছুই বলা আর শোনা হয়ে যায়। তারপর খালি ভাঁড় ফেলে দেওয়া। খালি ভাঁড় ফেলে দিতে হবে, বুঝলে তো?'
মনে পড়ছে না কে... শুধু মনে পড়ছে -- মারা গেছে। যার কথা মনেই পড়ছে না, তার অবর্তমান হওয়া এক প্রকার ভার হয়ে আছে ঘাড়ের কাছে। মাঝে-মাঝে মাথা নিচু করে হাঁটছি।
একটা পাওয়ার গ্রিডের মতোই মাথার ভেতরে মেমরি গ্রিড হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, ম্যারামৎ করার মতো একটা ব্যবস্থা থাকলে বড়ো ভালো হত। সার্জারির সময়ে যেভাবে যান্ত্রিক চাকতি করাৎ দিয়ে করোটির ওপরভাগ কেটে টুপির মতো খুলে নিয়ে ম্যারামৎ করতে হয়... ঠিক সেভাবে। মাঝেমাঝে কাছাকাছি মোজাইক করার শব্দ হলে অথবা যান্ত্রিক করাৎ দিয়ে লোহা কাটার শব্দ হলে মনে হয় এভাবেই কেউ ক্রেনিয়ামের ওপর থেকে টুপির মতো খুলে নেবে। কিছু নয়েজ, কিছু ডিস্টার্বেন্স ডিফ্র্যাগমেন্ট করে দেওয়া খুব দরকার। নিজে নিজে আর কিছুতেই হচ্ছে না এসব। পাকাপাকিভাবে অকেজো হয়ে গেল কিছু অংশ এই বয়সে এসে-- বুঝতে পারি। দুঃখ হয় নিজের জন্য। বুঝতে পারি বলেই দুঃখ হয়। নাহলে মাল্টিপ্লেক্সে বসে পপ-কর্ন খেতে খেতে কী ভালোই কাটিয়ে দিতে পারতাম বাকি জীবন।

CLICK NOW

(আর‌ও পড়ুন : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়'র, সিনেমা-বিষয়ক নিবন্ধ শাসকরচিত সিস্টেমের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে জুঝে চলার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠার সিনেমা 'I, Daniel Blake'।" সম্পূর্ণ পাঠ করতে ক্লিক করুন)  

একটা গাড়ি কোথাও তীব্র ব্রেক কষল, চিৎকার করে। ইডেন হসপিটাল রোড... মন্দিরের ভেতর জগন্নাথ একলা থাকেন। না, ঠিক একলা নয়... শিব লিঙ্গও আছেন। হরি-হর।
হাতে টানা রিকশা উলটে গেছে কাত হয়ে। বোকার মতো তাকিয়ে আছে বিহারী বৃদ্ধ। এই বয়সে এসে আর অন্য রোজকারে যাওয়া হয় না, অথচ পেট-চালানোর জন্য কিছু না কিছু করতে হয়। এদের তো পেনশন সিস্টেম হয় না। এদেরও মাসে হাজার-দেড় হাজার টাকা দেওয়ার মতো প্রকল্প খুলে দিলে পারত সরকার-বাহাদুর। কেমন দাঁড়িয়ে আছে অপারগ। মনে হচ্ছে-- কেউ হাত লাগালে তবে তুলতে পারবে রিকশাটা। অথবা, এখনো ভাবছে-- ঠিক কী ঘটে গেল!
সংবেদনশীলতা ভেসে যাচ্ছে জলের তোড়ে।
ও যেভাবে ওর রিকশার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি একই ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে। ঠিক যেভাবে রাস্তার কুকুর দাঁড়িয়ে থাকে, কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে। মানুষ তাদের পাশ দিয়ে চলে যায়।
আমাদের দেখে কারো মনে হতে পারে, এখনই আকাশের দিকে মুখ তুলে সুর করে ডেকে উঠব। আমাদের সঙ্গে হয়ত গলা মেলাবে আরো কেউ।
একটা অদৃশ্য সুইচ আছে যেন কারো হাতে। কিছু একটা ঘটবে... আমি এগোলে, অথবা অন্য কেউ এগোলে।
রাস্তার মাঝে ওভাবে একটা রিকশা পড়ে থাকতে পারে না বলেই হয়ত একজন এগলো, নিজের তাগিদেই... নিজের পথ পরিষ্কার করতে। সে এগলো বলেই আমাকে আর এগোতে হল না। অদৃশ্য সুইচ টেপা হয়ে গেছে। এবারে দুজনে বাকিটা সামলে নিতে পারবে।
দেখো ইডেন হসপিটাল রোডের হরি-হর... কেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখে যাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে আমারও। এমন লাউড নয়েজ, যে তা সরে গেলেও আর টিনিটাস থামে না। ঝিঁঝিঁপোকার মতো ডেকেই যায়।

খালি ভাঁড় ফেলে দিতে হবে...
খালি ভাঁড় ফেলেই দিতে হবে...
খালি ভাড় ফেলে দিতেই হবে...
খালি ভাঁড় ফেলে দিতে হবেই...

...ঠিক কী বলেছিল স্পষ্ট মনে পড়ছে না। এখন আর জিজ্ঞেসও করা যাবে না। কে বলেছিল তাই-ই মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে... মারা গেছে।

ট্রাম অথবা হাতে-টানা রিকশার ঘন্টায় লুকোচুরি খেলছে বৌদ্ধ বিহারের তোরণে ঝুলন্ত উইন্ড চাইম।
আর সামনে ভিড় করে থাকা রজনীগন্ধার স্টিকগুলোকে প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সরিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি জলের বালতিতে ডোবানো একটি মাত্র শ্বেত পদ্মের দিকে।

Comments

আরও পড়ুন

বীথিকা ধরে হেঁটেছে দীন

সংবেদন চক্রবর্তী

উপসংহার থেকে ফিরছি —কবিতা সিরিজ

এক গুচ্ছ কবিতা

প্রচ্ছদ আখ্যান

একটি কবিতা সিরিজ

তৃতীয়—মাস-সংক্রান্ত

তিস্তা পাড়ের মেয়েটি— কবিতা সিরিজ

দেবজ্যোতি দাশগুপ্ত

ছোট গল্পগুলি