কবিতা বিষয়ক গদ্য —
এক সভ্যতা, এক যুগের স্থাপত্য… আর এক যুগে অবশেষ হয়ে থাকে। প্রত্ন হয়ে থেকে যায়... যতটা থাকে, যদি বা থাকে।
কোনো এক শতাব্দীর চৈত্যে অনেক বছর পর লতাগুল্মের আবরণ সরিয়ে দিনের আলো প্রবেশ করে। বিস্মিত মানব-সন্তানদের পদচিহ্ন শোনা যায়।
দেওয়ালে, স্তম্ভে ভাস্কর্য আর প্রস্তরলিপি। কোনো প্রজন্মে আবির্ভূতা জাতিকা, অধীশ্বরী… ভাস্কর্য হয়ে আছেন। একের পর এক… শক্তির প্রতীক।
মানুষ ভাস্কর্য দেখে চেনার চেষ্টা করে। নিজস্ব মেধা এবং থিওরিতে তাঁদের একটা করে নাম দেয়, বর্ণনা নথিভুক্ত করে।
চেষ্টা করে। সবটুকু পারে কী?
কোনো কোনো প্রস্তরলিপিতে কারো সাক্ষরই নেই। কে যে লিখে গেছে এসব। কে যে কী দেখে গিয়েছিল… জানাতে চেয়েছিল…
প্রেত
উদ্যানে সান্ধ্যকালীন আনাগোনা ক্রমে হ্রাস পায়। হ্রদের এক ধারে, এক অতিকায় চেহারার কৃত্রিম ফ্ল্যামিঙ্গোর ডানায় পড়ে জ্যোৎস্নার আলো। আর হ্রদের জলে টলটল করতে থাকে তাম্রাভ চাঁদের প্রতিবিম্ব। কৃত্রিম ফ্ল্যামিঙ্গো, ঘাড় গুঁজে থাকে… মাথা তোলে না। তার চেয়ে অনেক ছোটো এক জোড়া পাখি (তারা কিন্তু কৃত্রিম নয়!) পাথরের ওপরে বসে থাকে মাথা নিচু করে। জলের তরঙ্গ দেখে। চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখে। ছোটো ছোটো মাছের চলাচল দেখে। তার চেয়ে অনেক বড়ো পাখি একদা ডানা মেলে উড়ে গেছে এই পৃথিবীর আকাশে। এমন অথবা এর থেকেও বড়ো কোনো প্রাকৃতিক হ্রদের ওপর দিয়ে। তার বিস্তৃত ডানায় উথলে পড়েছে জ্যোৎস্না। তার পালক ধীরে ধীরে ভেসে এসে শুয়ে পড়েছে ঘাসের ওপর। তারা এমন কৃত্রিমতা প্রসঙ্গে অজ্ঞাতই ছিল। সেই প্রাগৈতিহাসিক পাখি মেঘের মতো ডানা নিয়েই একদিন জীবাস্ম হয়ে গেছে।
জীবাশ্ম হয়ে গেছে তার জাদুপালক। জীবাশ্ম হয়ে গেছে তার অলৌকিক উড়ানভঙ্গী। জীবাশ্ম সৃষ্টি হয়, এভাবে কিছু রেখে দেওয়াও এক প্রক্রিয়া। এমন কিছু সচেতনভাবে রেখে দিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, যা অন্য কোনো সভ্যতা অথবা যুগে জীবাশ্মের মতোই আবিষ্কার করবে সেই সময়ের অভিযানকারীগণ। চিনবে ঠিক মতো, হয়ত নিজের মতোই অর্থ করবে তার। নিজের কিছু না, অন্য কারো প্রতি নিবেদন যুগান্তর পার করে রক্ষা করে দিয়ে যাব—এমন স্পর্ধা নিয়ে এক একটা রাত পার করে দিই বিষাদ বৈভবে।
মানুষের তো শুধু লম্বা পাঁচিল তুলে শান্তি নেই। তার ওপর পেরেক, তার ওপরে ভাঙা কাচ গেঁথে রাখা একের পর এক। এমন এক পাঁচিলে পেরেকে ফালা ফালা হাত… উন্মুক্ত আরবী তলোয়ারের মতো দাগ রেখে গেছে। A prevailing sense of Despair থেকেও নিজস্ব উত্তাপ জন্মায়, জ্বরের মতো… জ্বরের মতো ক্ষোভ… এবং উষ্ণ প্রস্রবণ। তানপুরায় পা-সা-সা-সা ক্রমাগত শুনতে শুনতে ঘোরের মধ্যে ডুবে যাই। আলো চোখে বেঁধে, শব্দ কানে লাগে। আঙুল চলে না, অথচ চললে এমন অনেক কিছু চলে আসতে কাগজে কাগজে… যা আসলেই ভুল বকা। অন্য সকলের কাছে ‘ভুল বকা’-ই। কোনো দৃকপাত না করে, প্রত্যুত্তরের সদিচ্ছা অথবা দায় না রেখে সহজেই অন্যত্র সরে থাকা যায়।
‘কেউ আজ ভালো নেই… কাল ঠিক হয়ে যাবে। বেঁচে তো নেবেই কোনো না কোনো উপায়ে! যেমন এ যাবৎ বেঁচে আছে কোনোভাবে…’
প্রাগৈতিহাসিক পাখির আত্মা কিংবদন্তী হয়ে ডান ঝাপটিয়ে চলে যায়। ভালোবাসার মতোই, ‘আত্মা’-কেও শুদ্ধ ভাবতে ভুলে গেছে মানুষ। বলে ‘প্রেত’। আরো নামিয়ে এনে বলে ‘ভূত’। তারপর ভুল বানান লেখে। ভুল উচ্চারণ করে।
ক্ষীণ স্পন্দন থেকে চোরাস্রোত। আর কিছু অথবা কেউ না থাকলে চোরাস্রোতেই ক্ষীণ স্পন্দন।
'Fond phantom,' cried shocked Father Shawn,
'Can there be such stubbornness--
A soul grown feverish, clutching its dead body-tree
Like a last storm-crossed leaf? Best get you gone
To judgment in a higher court of grace.
Repent, depart, before God's trump-crack splits the sky.'
From that pale mist
Ghost swore to priest:
'There sits no higher court
Than man's red heart.'
[Dialogue Between Ghost And Priest – Sylvia Plath]
সত্যাগ্রহ
একটা নিজস্ব রেজিস্টেন্স আর রেজলিয়েন্স-এর অদৃশ্য বলয় নির্মাণ করে আছি। এও মাঝে মাঝে ঢাল হয়ে যায়, কবচ হয়ে ওঠে। নাহলে রুখে দাঁড়াচ্ছি কীভাবে বার বার? সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছি কীভাবে? সামান্য মানুষ, সামান্য মেধা, গ্রীক পৌরাণিক দেবতা, অর্ধ-দেবতাদের মতো পেশীবাহুল্যও নেই, বিশেষ ক্ষমতাও নেই। অথচ নিজেই মাঝে মাঝে সকাল হলে হাত-পায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবি… শরীরের রোদ পড়লে ভাবি… কতগুলো দিন কাটিয়ে দিলাম এভাবেই! কত জন্ম…
মেলানকলিকে একেবারেই প্রশ্রয় না দিয়ে ফুলের পাপড়ি আর প্রদীপ দিয়ে রঙ্গোলি সাজিয়ে বসে থাকি।
ভিড়ের মধ্যে এর ওর পাশে কাটিয়ে ইষৎ ঝুঁকে জায়গা করে নিয়ে চলে যাই এক কোণ থেকে অন্য কোণের দিকে। কোথাও একটা জায়গা পেয়ে দাঁড়াই। কোথাও একটা বসার মতো জায়গা হলে বসি। একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকে… যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, আমাকে দেখতে না পেলেও। দেখতে না চাইলেও… আমি দেখতে পাই ঠিক।
নিবেদন কখনো দুর্বলতা হতে পারে না। যা দুর্বলতা হয়ে ওঠে, যা দুর্বল করে দেয়… তাতে ইষ্ট নেই।
নিত্যদিন সান্ধ্যকালীন উপাচার, এবং রাতে সবার শেষে একটি মৃৎপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা।
এভাবে এক যুগ অতিক্রান্ত করে নিজেই এক মৃৎপ্রদীপ হয়ে গেছি দেউলে। একে কি অস্তিত্ব হারানো বলে? কর্মযোগে বিচলিত হওয়া বলে?
জানি না।
জেদও বলি না। দাবিও বলি না। সত্যাগ্রহ বলে ডাকার মতো দৃঢ় হয়ে থাকে প্রজ্জ্বলিত শিখা।
The prevailing sense of being in a dedicated state of love itself is the purest virtue.
আগুন… সে আগুনই। সৃষ্টির শুদ্ধতম উর্জা। যাকে ছাড়া যজ্ঞও হয় না, আহুতিও হয় না।
সত্যাগ্রহীদের দুর্বল মনে হয়। কিন্তু অস্ত্র হাতে যেভাবে চোখে চোখ রেখে তাকানো যায়… চোখে আগুন নিয়েও তাকানো যেভাবে সেভাবেই। অন্তরের আগুন নিয়েও।
মন জানুক আর দেহ জানুক। দেহ জানুক… আর মন।
“ভয় নেই, আশাও কি নেই?
অসংখ্য জীবন আছে, আরো—
কীটজন্ম, পশুজন্ম, গাছজন্ম, বালি ও পাথরজন্ম
কিছুতেই আপত্তি করি না—
আমি থাকব পায়ে পায়ে,
দেখতে চাই ক’বার না বলো তুমি,
কতবার না বলতে পারো।”
[না, না এবং না – দেবারতি মিত্র]
আঁধি
একটা ব্যূহ রচিত হয়ে থাকে। অথবা এক ইনভিজিবল শিল্ড। সচেতনভাবে করতে হয় না। প্রকৃতি, মহাবিশ্ব আর নশ্বরতার মাঝেই কোনোভাবে তার আবির্ভাব হয়… জীবনচক্র অতিবাহিত হয়… এবং বিনাশও হয়। এক ব্যূহ থেকে আর এক ব্যূহতে ট্রানজিশন হয়ে যায় জীবন, পারিপার্শ্বিক, কাল।
নির্দিষ্ট তর্কে তত্ত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না, এমন অনেক কিছুই ধুলোয় উড়ে যায়। উড়ে যাক। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু মানুষের চোখ যা দেখতে পায় না, বা দেখতে চায় না… তা আর তাকে কে দেখাবে?
কাউকে কিছু দেখানোর ইচ্ছে প্রবলভাবে বাড়ে। অথচ না বোঝাতে পারার সীমাবদ্ধতাও জড়িয়ে থাকে মলীন শালের মতো। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরি সেই শাল। কারণ আর কেউ জড়িয়ে ধরছে না আপাতত। সব জড়িয়ে ধরা একরকম হয় না। সব জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেও একরকম হয় না। প্রবল শৈত্যে আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। শীত যাবে, বসন্ত আসবে… উৎসব করবে নগরের মানুষ। তাদের দেখে আমার ঈর্ষা হয় না। অথচ সেই ভিড়ে মিশেও যেতে পারি না উল্লাসে উচ্ছ্বাসে।
হে মহাপৃথিবী, আমার কি উদযাপনের স্পৃহাও ক্ষয় হয়ে গেছে এক ব্যূহ থেকে আর এক ব্যূহে?
অন্ধকার গলি পার করে যাওয়ার সময় এক বৃদ্ধ ভুল করেই আমাকে এক সন্ধ্যায় – ‘বিপ্লব’ বলে ডেকেছিল। এক বার নয়, দু-বার। আমার কেবলমাত্র একবার তাকিয়েই এগিয়ে যাওয়ার কথা। অথচ তার মুখ, কন্ঠস্বর সেই স্পষ্ট জিজ্ঞাসা—কোনোটাই ভুলতে পারি না।
এক অন্য ব্যর্থতার অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে। অথচ সে ব্যর্থতাও অন্যের। অন্ততঃ আমার একার নয়। অথচ ওই ‘বিপ্লব’ নামটা নিতে হলে তার কণ্টক-কিরীটও আমাকেই ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে অন্ধকার গলিতে।
সেই গলিতে, যেখানে হয়ত এমনই কোনো রাতে আইনরক্ষকের গুলি লেগেছিল কোনো যুবকের পিঠে।
ভালোবাসার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে শাহাদত আসে।
পিঠেও গুলি লাগে।
শেষ শীতের প্রত্যূষে, এক মধ্যবয়স্কা কেতকী গাছের প্রায় সব শাখাই পত্রহীন। অথচ ফুল ফুটে আছে। এমন দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াই। দীর্ঘ রাতের পর মাঝে মাঝে এমন দিন আসে।
আমরা তো এমনিতেই ‘আউটসাইডার’। এমনিতেই শরনার্থী। কেউ চিনতে পারলেই মনে হয় অনেক হল এই নশ্বরতায়। সেখানে আবার ‘মনে রাখা’-র প্রত্যাশা। কতটাই বা বদলে যাবে কিছু রাত জেগে থাকলে, অথবা অভুক্ত থাকলে… বিশেষ কিছু বা কোনো জনের প্রতি নিবেদন-সংকল্পে?
উদযাপনের স্পৃহা হ্রাস পায়, কিন্তু ইবাদৎ-এর পবিত্র ইচ্ছা থেকে কখনো স্খলিত হইনি। এই ইচ্ছা স্পর্ধা হয়ে ওঠে… এক ব্যূহে থেকে আর এক ব্যূহে। বিশাল মরুভূমিতে এক প্রান্তে জন্মানো আঁধি… ঘুরতে ঘুরতে ধেয়ে যায় দিকচক্রবালের উদ্দেশ্যে।
“But your eyes with their silent scream
Will blur my vision
Like your dark secrets that
Build a wall around me.
At last one day…
I’ll flee from the illusion of conceiving doubt
And I’ll radiate like a perfume from
the colorful flower of dreams
And I’ll diffuse into the wavy hair of night’s zephyr
And travel to the very beaches of the Sun
In a silent world, within an eternity of calmness.”
[The Wall -- Forough Farrokhzad : মূল ফারসী থেকে ইংরেজি অনুবাদ - Pari Kooshesh ]
Comments