নীলাঞ্জন'র চোখে কবি গোলাম রসুল

 







লেখক নীলাঞ্জন'র চোখে

 কবি গোলাম  রসুল 


কবি পরিচয় :
কবি গোলাম রসুলের জন্ম ১৫ই মার্চ -এ। তাঁর সংযোজন বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে অন্যমাত্রয়। হঠাৎ করেই একক ছত্রে কবিতা দেখতে দেখতে কবিতা লেখা শুরু করেন তিনি। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকে দীর্ঘ সময় পালন করেছেন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। বাংলা ইতিহাসে প্রায় সকল বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রিকায় নিয়মিত লিখে চলেছেন এখন পর্যন্ত।


"ঈগলের রঞ্জনাহীন অশ্রুর স্পষ্ট বিবর্ধনে দেখি,

  নিবন্ত বিম্বের ভিড়ে

  একজন মানুষ— কাঙালের চেয়েও নিঃস্ব বুকের পাতায়

  কেমন করে কবির মতো

                      কৃষ্ণশীলার সমৃদ্ধি লিখে যেতে পারে।

                       (কবির মতো মানুষ, নীলাঞ্জন চক্রবর্তী)


মহাজাগতিক কবি গোলাম রসুল সম্পর্কে লেখা এই বক্তব্য আমার গভীরতম অবচেতনার ফল অথচ সচেতনতার ইন্দ্রিয়ে যতোই গভীরে যাই তাঁর চিন্তাশীলতা, দার্শনিকতা এবং সাধারণত্বের আবরণ আমায় মুগ্ধ করে।


জীবনে কোনো কবিকেই আমি এতটা কাছ থেকে অনুভব করিনি যতটা অনুভবের সুযোগ ঘটেছে কবি গোলাম রসুলের ক্ষেত্রে। কবিদের কেমন হতে হয় তা নিয়ে বিশেষ ধারণা ছিলনা আমার। প্রথমে মনে হতো ছন্দই বুঝি কবিতা, পরবর্তীতে দেখি দার্শনিকতার এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে; তারও পরে সময়ের সাথে কবি ও কবিতার পরিবর্তন এবং যুগান্তর দেখা হল। পড়লাম বহু কবির ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন ধারার কবিতা। তবে প্রথমেই যেখানে হোঁচট খেলাম তার নাম ‘বোধ ’

কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়—


সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।

কে থামিতে পারে এই আলো আঁধারে

সহজ লোকের মতো; তাদের মতোন ভাষায় কথা

কে বলিতে পারে আর...

                        (বোধ, জীবনানন্দ দাশ)


এমন সহজ উচ্চারণ যেন সবচেয়ে বেশি কঠিন করে ধরা দিল আমায়, বদলে গেল ভাবনার সমীকরণ, বদলালো দর্শন। সমস্ত প্রচলন ভুলে শুরু হলো শুধু সহজের অনুসন্ধান, আলোর অনুসন্ধান— জীবনের পরেও যে আরো এক জীবন সেই মহাজাগতিক সত্যের গবেষণা। কবি জীবনানন্দ যে ঝড়ে ফেললেন আমায়— চিনিয়ে দিলেন প্রকৃত জীবন কাকে বলে, এই অলীক দুঃখের পর্দা ঠেলে শুরু হলো প্রকৃত শান্তির অনুসন্ধান। এ যেন নিজের ভিতর নতুন আরেক নিজের আবিষ্কার!

সাধকের মতো ভ্রমণ করেছি মনের গহীনতায়, অন্ধকারে হারিয়েছি পথ, বহু তারা জ্বলে নিবে গেছে অথচ জীবনানন্দের মতো কোনো নক্ষত্র পাইনি খুঁজে।

এমনই হতভাগ্যতার আঁধারে একদিন দেখি আকাশে উঠেছে চাঁদ— “বিস্ময়ের গলিতে চাঁদ”


বিস্মিত আমি সেই আলোয় দেখি মানুষের মতো ছায়া অথচ সত্যিই কি মানুষ নাকি মহাজাগতিক ধূলিকণা দিয়ে নির্মিত কোনো মূর্তি!

“দিগন্তে আমি একা”— যেন ডাক দিলেন, এসো আবিষ্কার করো এই জনপদ যেখানে সমস্ত বাসনা তুচ্ছ হয়ে যায়, জীবন এখানে থেমে আছে শুধু জীবনের অপেক্ষায়। সেই থেকে শুরু হলো পথ, তবে এইবার ভ্রমণ একসাথে। জীবনে প্রথম ভীষন কাছ থেকে অনুভব করলাম একজন কবিকে। আপাতদৃষ্টিতে যেরূপ সাধারণ তাঁর আবরণ, অতি সৌভাগ্য অথবা দৃষ্টির গভীরতা ছাড়া তাঁর মহাজাগতিক জ্যোতি দর্শন অসম্ভব।


কেঁদো না মা আমায় কবর দেওয়ার জায়গা নেই

মেঘে মাটি রয়েছে

সেখানে রেখে এসো আমার অবৈধ মৃত্যু।

               (বিস্ময়ের গলিতে চাঁদ, গোলাম রসুল)







মৃত্যুর অবৈধতা! ঠিক এখানেই বোঝা যায় তাঁর গভীরতার অনুভব। মনে পড়ে যায় Freddie Mercury'র লেখা— “I don't wanna die and sometimes wish I never been born at all”


জীবনের অনিশ্চয়তা বারবার ফিরে আসছে, আমরা যে ভীষণ বিপন্ন, আমাদের ক্ষণিকের আমোদ, উল্লাস যে কতটা মূল্যহীন বুঝিয়ে দিচ্ছেন—


এখন প্রবল হাওয়াই আমাদের সব ভরসা

রাতে করুণার অন্ধকারে আকাশে অনেক তারা

আয়নার ভেতরে চুল আঁচড়াচ্ছে সভ্যতা।

                  (বিস্ময়ের গলিতে চাঁদ, গোলাম রসুল)


যে জনপদ, যে সমাজ দেখছি আসলেই যেন নকল কিছু প্রতিবিম্বের মাঝে রয়েছে আমাদের বাস। অন্ধকার করুণা করেছে আমাদের গভীরতর কৃষ্ণময়তা হতে, প্রবল হাওয়া কিম্বা প্রলয়স্বরূপ ধ্বংসই যেন অন্তিম মুক্তির পথ।


এখানেও ফিরে এসেছে জীবনের কথা— এই অপরিকল্পিত, ত্রুটিপূর্ণ জীবনের ঊর্ধ্বে সংশোধিত, রিপু বহির্ভূত অস্তিত্বের কথা। যে প্রশ্নের মাঝে কবি জীবনানন্দ আমাদের দাঁড় করিয়েছেন, কবি গোলাম রসুল যেন এই যুগে সেই সমস্ত উত্তর দিয়ে চলেছেন নিরন্তর। তাঁর ভেতরে তাকালে রক্তমাংসের মানুষ নয় যেন দেখা মেলে শুধু মহাজাগতিক আলোর— যিনি হয়তো এই পৃথিবীর নন, এই সময়কালের বহু ঊর্ধ্বে তাঁর বিচরণ। চিন্তাতরঙ্গের বিভবপ্রভেদে আমরা তাঁর কবিতার কতটা গভীরতা স্পর্শ করতে পারছি বা পারবো জানা নেই কিন্তু জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি দিনের আলোয় এবং প্রত্যেক রাতের আঁধারে তাঁর বক্তব্য ছড়িয়ে আছে। যেন পরমব্রহ্ম নিজের সমস্ত উচ্চারণ ফুটিয়ে তুলেছেন কবির শব্দে, ছন্দে ও ভাষায়।


একবার কবি বলেছিলেন— “যদি সম্ভব হতো মৃত্যুর পর আমি নিজেই নিজের দেহ সৎকার করতাম”। কোথাও তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমাদের এই জীবন উপহারে পাওয়া আর দেহটি আমরা ভাড়া নিয়েছি সৃষ্টিকর্তার করুনাগৃহ থেকে”।


জীবন সম্পর্কে এত অকপট ও স্পষ্ট অনুসন্ধান আগে দেখিনি। নিছক কবি নয় যেন জীবনের প্রকৃত অর্থ অনুসন্ধান ও বুঝিয়ে দেওয়ার কর্মযজ্ঞে লিপ্ত এক ধর্মনিরপেক্ষ সাধক—


“মানুষ কখনও নিখুঁত নয়

অনুশীলন করে মেঘ

বৃষ্টি পড়ে

আমাদের অসহায় শূন্যের চেয়ে শুন্য"  

(শূন্য যেখানে শূন্য নয়, গোলাম রসুল)








আলোচনা করেছেন : নীলাঞ্জন চক্রবর্তী

জীব ও জীবনের পরম রহস্য সন্ধান হেতু মফস্বলের স্বর্ণ সবুজ আলোয় কবিতার সাথে আকস্মিক আলাপ হয় নীলাঞ্জনের। তারপর থেকে পংক্তি ও অলঙ্কারের আলোয় চলছে শুধুই অজানার অনুসন্ধান, অদেখাকে দেখার অদম্য বাসনা তার জীবিত চোখের তারায়। সাহিত্য জগতে প্রথম আত্মপ্রকাশ একক কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদয় স্পর্শ করুক’ এর হাত ধরে। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘কচিপাতা দ্বিমাসিক’ পত্রিকায়। এরপর ছায়াবৃত্ত, সময়বৃত্ত, ইতি তিলোত্তমা, অক্ষর সংলাপ, শব্দসাঁকো সহ লিখেছেন অসংখ্য সাহিত্যপত্রে। ভিড়ের বাইরে নির্জন ভ্রমণ তার অন্যতম প্রিয় নেশা।







Comments

আরও পড়ুন

একটি কবিতা সিরিজ

তিরিশের যুবক, জন্মদিন ও চিয়ার্স— কবিতা সিরিজ

ছোট গল্পগুলি

একটি কবিতা সিরিজ

সুদীপ চট্টোপাধ্যায়

কবিতা

নবীন সরকার