ব্যক্তিগত গদ্য—
আমাদের জীবন মাঝে মধ্যে ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে। অজান্তেই। মৃদু-কল্লোল ষড়যন্ত্র। দহনের পরেও তার সুর, সুগন্ধ দীর্ঘ আলাপচারিতায় জীবনের নানা অধ্যায়ে প্রবাহিত হয়। আমার জীবনের এমনই এক অধ্যায় পার হয়ে গেল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে। হয়তো আরো অধ্যায় এমন; এমন করে পার হয়ে যাবে। হয়তো এমন করে আমার ভালোবাসা বেঁচে থাকবে তোমার বুকে। তোমার হবে কি? না। তোমাদের হবে। আমার ভালোবাসা বেঁচে থাকবে তোমাদের বুকে। জীবনে যতবার প্রেমে পড়েছি, মনে হয়েছে নারকেল গাছের মাথা থেকে মাটিতে পড়েছি। যত সময় হাওয়ায় ভাসছি তত সময় ময়ূরীর হাওয়া। আর তার পর... তার পর মন দেহ সব ভেঙে চুরমার। শব্দহারা সমর্পণ যেমন। শক্তির কবিতা আমার কাছে তেমন। শব্দহারা সমর্পণ।
আমার প্রথম প্রেমিকা ছিলেন সাহিত্যের শিক্ষার্থী। একদিন ফোনে কথা কাটাকাটিতে বলেছিলাম, তুমি এটা করো না ওটা করো না বলে একটা ভালো কবিতা শোনাও তো। তখন আমাদের প্রেমের শুরু। শুনিয়েছিলেন, 'আনন্দ-ভৈরবী', "আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি/এমন ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা/উদ্যানে ছিলো..." আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। দৃশ্যের সমাহারে নিজেকে লুকিয়ে নেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। তখনো পর্যন্ত আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটিই কবিতা জানতাম। যে'টি দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়েছি, 'আমি দেখি'। সেই কবিতা পড়ার অনেকদিন পর, 'বরষা-পীড়িত ফুল'! বড় দাদুর বাড়িতে বসে থাকা সন্ধ্যার সময়কে রাত্রির ঢালে পৌঁছে দিয়েছিল এই কবিতা। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে সুরের মূর্ছনা আলাপ। বেদনার নির্লিপ্ত প্রস্তাব যেন আমাদের শৌখিন-নিস্তব্ধ করেছিল। প্রায় শতাধিকবারের বেশি এই কবিতাটি শুনেছি ওঁর গলায়। অবশ্যই, বিরক্ত হতেন। তবু আমার আবদার ফেলতেন না। যখন এই লাইনটি আসতো, 'সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি/আনখ সমুদ্দুর'; আমি সহাস্যে বারবার জিজ্ঞেস করতাম, কে? কে? মৃদু হেসে বলতেন, তুমি। সময়ে সুযোগে টের পাই তুমি উচ্চারণের বিহ্বল ভার আমি বহন করতে পারিনি। সহ্যের নাশকতাকে পৌঁছে দিয়েছি পাহাড়ি বনের ধারে। তার পথের শেষ সীমানায়। সীমানার দিঘল তীরে।
'আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি'
এমনও হয়েছে কয়েকবার, বাম পায়ের এসিএল সার্জারির পর যখন আমি বাড়িতে বস্তি, ফোনে ঠিক করে কথাবার্তা হতো না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা শোনানোর লোভ দেখিয়ে কাদা পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতেন বড় দাদুর বাড়ি। বড় দাদুর বাড়ির বারান্দা, প্লাস্টিকের চেয়ার, কাঠের বেঞ্চ ও নিস্তব্ধ রাত্রির আমি। শুনিয়েছিলেন, 'এখন সন্ধ্যা হয়েছে ঘোর, কেবল মেঘে-মেঘে-মেঘেই/দিন ফুরালো'। আমাদের দিন ফুরিয়ে যাওয়ার কারণ শুধুমাত্র মেঘের উপর গিয়ে পড়বে তা জোর করে বলার কবিতা ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতা : 'ঝাউয়ের ডাকে'। 'এখন নিথর রাত্রিবেলা/জলের ধারে কেবলি হয় জলের খেলা/অবর্তমান তোমার হাসি ঝাউয়ের ফাঁকে'
প্রথম প্রেমের প্রায় দেড় বছর পর জীবনে আবারো প্রেম এসেছিল। প্রেমিকা ছিলেন আমার স্কুলের জুনিয়র। রাগী, বদমেজাজি। স্কুলের গ্রাউন্ড ফ্লোরের সিঁড়ির তলায় বন্ধুদের সাথে আড্ডার সময় যাঁর যাতায়াত ঝর্ণার দোল দিত তাঁর সাথেই প্রেম হলো, দীর্ঘ কয়েকবছর পর। ফেসবুক সূত্রে। যেকথা স্কুল সময়ে বলতে পারিনি, যে শব্দোন্যাস নিরব ছিল তার আর্তি ঘটে প্রথম প্রেমের দেড় বছর পর। কথায় কথায় একবার বলেছিলেন, তুমি তো ভালো কবিতা লেখো, একটা কবিতা শোনাও। আমি বললাম, আমার নয়; একটা ভালো কবিতা শোনাই, শোনো— 'রেখেছিলাম পদচ্যুত নূপুরখানি/যখন তুমি চাইবে জানি/অনন্যোপায় — দিতেই হবে/অনুভবে'। কবিতার নাম 'স্থায়ী'। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এর পরের থেকেই সময়ের মূহুর্তকে আচ্ছন্ন রেখে তাঁর মনের স্রোতে মাঝেসাঝে উচ্চারিত হতো, শক্তির কবিতা শোনাও, শক্তির কবিতা শোনাও। আমি বলতাম, কেন? আমার কবিতা পছন্দ নয়?
— না।
দুঃখের কবলে যে এত ধিক্কার তা টের পাই। গ্রহণ করি। শোনাই, 'যে-দুঃখ পুরনো, তাকে কাছে এসে বসতে বলি আজ/আমি বসে আছি, আছে ছায়া, তার পাশে যদি দুঃখ এসে বসে/বেশ লাগে, মনে হয়, নতুন দুঃখকে বলি যাও/কিছুদিন ঘুরে এসো অন্য কোনো সুখের বাগানে/নষ্ট করো কিছু ফুল, জ্বালাও সবুজ পাতা, তছনছ করো/কিছুদিন ঘুরে দুঃখ ক্লান্ত হও, এসো তারপর/বসো।'
— তোমার কবিতা?
— না। (যা শুনতে চেয়েছিলেন)
এ'সব কথা তেমন কেউ জানতো না। বড় দাদুর বাড়ি, দেওয়ালের ময়ূর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা ও আমার কবিতার পাণ্ডুলিপি ছাড়া তেমন কেউ জানতো না। আমার কবিতা বই 'কালো মেঘের পাড়া'-এর উৎসর্গ পত্র ছিল বড় দাদুর বাড়ি ও কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি। বড় দাদুর বাড়ি, উঠোন, বারান্দা, বারান্দার জানালা, চেয়ার, বেঞ্চ, দেওয়ালে আঁকা মাটির ময়ূর, ন্যাতার আদর না পাওয়া নোনা ধুলো আমাদের সব জানতো। সবকিছু। যে কথা স্মরণে থাকতো না, হয়তো সে'কথাও। মনে রাখতো। বড় দাদুর মাটির বাড়ি আর নেই। নতুন বাড়ি হয়েছে। পাকা বাড়ি। আমি হারিয়েছি আমার লেখার জায়গা, আমার পাঠের জায়গা, শোনার জায়গা, শোনানোর জায়গা, আমার প্রেমের জায়গা। যখন মনে পড়ে, ময়ূরের গলা কাটা পড়েছিল কোদালের ভারে, তখন শুধু নির্বাক থেকেছি। মনে মনে আওড়িয়েছি 'এখনো বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে/ বিদ্যুৎ-রেখা মেলে'। বিরহের স্বেচ্ছাচার, অনভিপ্রেত সুর ক্লান্ত করে। এখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বই ছাড়া তেমন আর কিছুই নেই আমার কাছে। খুলে খুলে তারও ওপর মাঝে মাঝে ব্লেডের আঁচড় চালাই। নিজের ওপর পারি না তাই। কষ্ট হয়। আসলে আমি মনের মানুষ কিনা, দেহের হতে পারলাম কই! মনকে কি আর অমন করে ব্লেড দিয়ে নিজে নিজে আঁচড় কাটা যায়? মনের দহন কি বৃষ্টির কুশলতাকে স্বাগত জানায়?
'ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে।'
Comments
তবে, কিছু বানানে টাইপো হয়ত, চোখে লাগছে খুব।