শুভ্র সরকার
বন্ধ, ভাঙা হলুদ একটা জানালা
শুভ্র সরকার
নীতেশ, ভুলে কামড় পড়ে যাওয়া জিভের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিব্রত একটা দাঁত। সে দাঁড়িয়ে আছে চেনা কিন্তু পরিচিত নয় একটা জানালার পাশে। বন্ধ, ভাঙা একটা জানালা। হলুদ রঙ করা। চলটা ওঠা। যেন উঠোনে কেউ হলুদ একটা পেটিকোট নেড়ে দিয়ে গেছে—যা মূলত উঠোনটাকে আরও বেশি দৃশ্যযোগ্য করে তুলেছে ।
ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে নীতেশের জানা নেই। তবে আমপাতার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যেই মুখ ফসকে যাচ্ছে ভোরের আলোর। নীতেশ যখন এসেছিল, উঠোনের সারামুখে লেগেছিল চাঁদের কষ। মেঘ আর চাঁদের কথা কাটাকাটির মধ্যে উঠোনে কিশোরীর ফ্রক উড়য়ে গোল গোল ঘুরছিল অন্ধকার। বোবার ইশারার মতো সেই অন্ধকারটা এখন দাঁড়িয়ে আছে আলোর কাছাকাছি। দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু ক’রে। চাঁদটাও ততোক্ষণে বৃদ্ধার শুকনো স্তন—আভাহীন। একটা থান কাপড়ের প্রাদুর্ভাবেই নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বসে আছে।
অন্ধকারের এমন আলো হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা নীতেশের অদ্ভুত লাগে। মৃত্যুকে এতো সহজভাবে আর কে মেনে নিতে পেরেছে! মানুষের বেঁচে থাকার যৌক্তিকতা চুরমার করে দেয় এই দৃশ্য। নীতেশের মনে হয় বেঁচে থাকা মূলত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা। বন্ধ, ভাঙা একটা জানালা—যেটা হতে পারতো একটা পেটিকোট, হলুদ রঙের। যুবতীদের যোনির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হতে পারতো যার জীবন। যেখানে ওই যুবতীয় যোনি একটা জানালা। আর হলুদ পেটিকোটটা নীতেশ। যে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধ, ভাঙা একটা জানালা।
দাঁড়িয়ে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া একটা হাওয়া কোন গাছেই মানিয়ে নিতে না পেরে নীতেশের গায়ে এসে পড়ে। একে অন্যের পায়ে হোঁচট খায় নীতেশের চুলগুলো। তারাও মানিয়ে নিতে পারছে না। অথচ নীতেশ জানে, মানিয়ে নে’য়া ছাড়া মানুষের আর কোন গতি নেই, সমস্তটাই দুর্গতি। নীতেশ জানালার আরও একটু কাছে এসে দাঁড়ায়। কান পাতে জানালার মনে।
অন্যপাশে ঘুমিয়ে আছেন নীতেশের মা। হয়তো বাবাও। এমন হতে পারে তারা ঘুমিয়ে নেই। জেগে আছেন। নিচু গলায় কথা বলছেন। হয়তো কথাও বলছেন না, শুধু শুয়ে আছেন। পাশাপাশি কিংবা পাশাপাশি না। হয়তো বাবার হাতটা মায়ের বুকে শ্বাস নিচ্ছে—যে শ্বাস নে’য়ার ভিতর একটা মাদী হাঁস বিড়ালের নিয়ে যাওয়া বাচ্চার স্মৃতির পাশে দিনমান বৃষ্টি ঝরিয়ে যায়।
বৃষ্টি বাবার স্মৃতি ধুয়েমুছে দিলে নীতেশ শর্মীর দিকে যায়। শর্মীর ধারে একটা জানালা ততোক্ষণে বৃষ্টি খুলে বসে। কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটাকে পতনের বিড়ম্বনা থেকে হাত ধরে তুলে আনে শর্মী। নীতেশ ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকেও তুলে আনে শর্মী। বুকে জলের স্পর্শ দেয়। ভেজা একটা ধানখেত নীতেশের বুকে মায়ের হাতে চড় খাওয়া পুত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কাস্তে হাতে কাদাজল ভেঙে শর্মী নেমে পড়ে ধানখেতে।
এদিকে, উঠোনে হলুদ মনমরা একটা পেটিকোট ভিজে যাচ্ছে। কেউ তাকে ঘরে ডেকে নেয়নি। যদিও হলুদ পেটিকোট নিজেই একটা ডাক। একটা ইশারা। মাছ বাজারে পায়চারি করা বিড়ালের দিকে ছুড়ে দেয়া পেট পচা পারশে মাছ। নীতেশ প্রথম অবহেলা শিখেছিল ওর বাবার কাছে। ওভাবেও কেউ চলে যেতে পারে! এরপর যতোবার নীতেশের গলায় মায়া-মমতা বিঁধেছে, ও অবহেলার পা জড়িয়ে ধরেছে। আজও ওর সমস্ত ডেকে যাওয়া জানলার পাশে দাঁড়ানো মানুষটার না বলে চলে যাওয়ার স্পর্ধার দিকে চেয়ে আছে। এই অনিশ্চয়তা নীতেশকে শিখিয়েছে—চিলের কাছে আকাশ এক যাবজ্জীবন সাজা।
উড়তে পারলেও পাখি হতে না পারা কীটের ডানার করুণ মন নিয়ে, নীতেশকে তাই ঝাড়ু দিয়ে উঠোনের এককোণে জড়ো করে রাখে শর্মী। উঠোন তখন সেই হলুদ পেটিকোট। পাড়ার সবথেকে সুন্দরী যুবতীর বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সদ্য বিবাহিত যুবকের গলার মতো নেমে যায় নীতেশ।
কিন্তু কোথায় যায়? দ্বিধার এপাশে, বৃষ্টির ওপাশে—একা একটা ঘর ওকে জানালার দিকে যেতে দেখে। তবু কোথাও যাবার প্রশ্নে, নীতেশ উত্তরের দিকে সরে সরে যায়। আচ্ছা, উত্তরে কেউ ভুল করলে, তাকে কি আবার প্রশ্ন করা হয়? এই সমস্ত উৎকণ্ঠার ভিতর একটা মাদারচোদ জন্ম জীবনকে নিয়ে নিরত মৃত্যুর খোঁজ করে।
অথচ আমাদের খুঁজে পায় নাসীরনগর গ্রামের মতো রাত। যেখানে বহুকালের ধুলো ঝেড়ে হয়তো বাবা মায়ের উপর উঠে পড়বেন। হয়তো পরদিন দুপুরবেলা উঠোনে পানের বাঁটা নিয়ে বসা প্রতিবেশী বৃদ্ধার গল্প থেকে অল্প দূরে, অন্যবাড়ির কুকুরের মতো ইতস্তত ঘুরঘুর করবে সামান্য রোদ—অপ্রত্যাশিতভাবে মাও। চোখে পড়বে শহিদুল জহিরের ছোটগল্পের মতো মায়ের মুখ—সামান্য রোদ সেখানে বৃষ্টি শেষের উঠোনে বারবার পা পিছলে পড়ে যায়।
নীতেশ এখন জানালা থেকে কিছুটা দূরে—যতোটা দূরে থাকলে পিয়নের এইমাত্র দিয়ে যাওয়া চিঠি অন্যের হাতে খুলে যায়। খুলে যাওয়া জানালা নাকি চিঠি, কার বলার থাকে বেশি—এই চিন্তার পাশে মৃত মানুষের আয়ুরেখার মতো পিয়ন রেখে যায় সাইকেলের চাকার দাগ। জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরের মনেও আলোর দাগ পড়ে। হলুদ পেটিকোট জীবনের মুখে ছুড়ে দেয়—সামান্য রোদ, শহীদুল জহির এবং অন্যবাড়ির কুকুরটা।
সন্তানকে খুঁজে বেড়ানো মাদী কুকুর নীতেশদের পাড়ায় ভোর ডেকে আনে। রোগা হাওয়ায় কিশোরীর বারবার ওড়না ঠিক করার অভ্যাসে শিউরে ওঠে পাতা। দাঁতের পরে রেখে দে’য়া ভোরবেলা, উঠোন থেকে জানালা অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে ব্লাউজের বোতাম খুলে ছড়িয়ে পড়ে। নীতেশ জানালা থেকে সরে আসে। যদিও সরে আসা মূলত ছল। নিজেকে মিথ্যে বলা। তবু নীতেশ সরে আসে। সে ওই পিয়নকে চিনে ফেলেছে—যে বৃষ্টিকে রঙ করতে জানতো কিংবা সেই কুকুরের করুণ ডেকে যাওয়া—সঙ্গমের মাঝে যাকে পিটিয়ে আলগা করে দিয়েছে লোকে।
যদিও বন্ধ, ভাঙা একটা জানালার অন্যপাশে তখনও ছাদের দিকে দুই পা ছুড়ে মা দ্বিধাহীনভাবে বাবার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছেন।
Comments