প্রবন্ধ: সুরজিৎ বেরা
ইতিকথায় জটার দেউল : উৎপত্তি ও জন্মতথ্য
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে ইতিহাস আলোচনার স্থান প্রায় শূণ্য বললেই চলে। কিছু পুরাতত্ত্ব অনুসন্ধান চললেও তাতে ইতিবাচক দর্শন তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি। শুধুমাত্র মধুহীন ফুলের মত সৌন্দর্য বহন করেছে; প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনা তো অনেক দূরের ব্যাপার। তার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণায় অবস্থিত জটার দেউল। ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, সুন্দরবন গবেষকগণ প্রমুখ প্রচুর সময় ধরে গবেষণার পরেও 'জটার দেউল' এর ইতিহাস নিয়ে সম্পূর্ণ ইতিবাচক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারেননি। একের পর এক তর্ক বিতর্ক জমেছে এই দেউল নিয়ে।কুজ্ঝটিকাচ্ছন্ন ছায়ামূর্তি যেন নৈবেদ্য সাজিয়ে রেখেছে সৌধ জুড়ে। বিষয়সমূহের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সবগুলিতে বিশেষ আলোচনা প্রণালী রয়েছে।শ্রী বিনয়কুমার সরকার তাঁর 'ঐতিহাসিক প্রবন্ধ ' পুস্তকে বলেছেন -" মানব কখনও কোন দেশেই সার্বজনীন চরম সত্যের উপলব্ধি করে নাই। সকল যুগেই মানবসমাজ কালোপযোগী সমস্যার মীমাংসা করিয়া সাময়িক ও প্রাদেশিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছে মাত্র।"
মণিনদী, আদি গঙ্গা ও তাদের অজস্র শাখানদী, উপনদীর জটিল অববাহিকায় জটা-কঙ্কনদিঘী-রায়দিঘী অঞ্চলের বুকে পোড়ামাটির শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৩০ মিটার দীর্ঘ এই প্রাচীন মিনার- জটার দেউল। 'জটা' বলতে বোঝায় জটাধারী শিবকে আর 'দৈউল' হল মন্দির বা দেবালয়। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে এই এলাকার নাম হয় জটা। এই সৌধ নিয়ে হাজারো গল্প রয়েছে লোকমুখে। রয়েছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ছাপ'ও; যা অহংকার হিসেবে বহন করে চলেছে বাধা-বিড়ম্বিত সুন্দরবনবাসী।
ইংরেজ আমলে এই অঞ্চলের লট নং নির্ধারিত হয় ১১৬। সেই সময় এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। ১৮৬০ এর দশকে জমিদার দূর্গাপ্রসাদ চৌধুরী ও দিগম্বর মিত্রের নেতৃত্বে সুন্দরবনের এই অংশের জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদি পত্তনের কাজ শুরু হয়। এমনকি হিংস্র বাঘের মোকাবিলা করার জন্য ফিলিপ নাথ নামক শিকারি নিয়োগ করেছিল ইংরেজ সরকার। তিনি ১৫টি বাঘ মেরেছিলেন। সেই সময়কালে ১৮৬৮ সালে জঙ্গলের মধ্যে প্রথম আবিষ্কৃত হয় এই দেউল।
আবিষ্কারের পর থেকে এই দেউল কখন কিভাবে তৈরি হয়, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকবিদদের মধ্যে। অনেকে মনে করেন পালরাজাদের সামন্ত চন্দ্র বংশের অন্যতম রাজা শ্রীচন্দ্রের প্রথম পুত্র জয় চন্দ্র বা জয়ন্ত চন্দ্র ৮৯৭ শকাব্দ বা ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর 'যশোর খুলনা' গ্রন্থে এই সৌধটিকে প্রতাপাদিত্যের বিজয়স্তম্ভ বলে বর্ণনা করেছেন। বলা হয় ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তৎকালীন বঙ্গদেশ আক্রমণকারী মুঘল সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করে প্রতাপাদিত্য যশোর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হল এই জটার দেউল। কিন্তু ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই সৌধের নিকটে প্রাপ্ত এক তাম্র ফলক থেকে উক্ত সতীশচন্দ্র মিত্রর ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তৎকালীন ডায়মন্ড হারবারের ডেপুটি কমিশনার সেই ফলক সকলের সামনে আনেন। যাতে প্রতিষ্ঠাতা জয়ন্ত চন্দ্রের নাম ও সময়ের উল্লেখ ছিল। তবে বহুকাল যাবত তেমন তাম্র ফলকের কোনো খোঁজ নেই।
ভাবতে অবাক লাগে সময় কেমন করে সৃষ্টির বুক থেকে সৃষ্টিকর্তার নামটুকু মুছে ফেলে, অথচ সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখে। সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে ঘেরা এই জটার দেউলের কথা আমরা কজনই বা জানি, তবে অনন্তকাল ধরে সুন্দরবনের বুকে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত এই সৌধ।
তথ্যসূত্র : (১) উইকিপিডিয়া - জটার দেউল (২) সংবাদ - নিউজ 18 বাংলা (৩) 'জটার দেউল - লোককথা ও প্রত্নতত্ত্ব' - দেবীশঙ্কর মিদ্যা।
Comments