কৌশিক সেন
ভারতীপিসি আর ভাঙা লণ্ঠনের ইতিকথা
কৌশিক সেন
লন্ঠন নামিয়ে রেখেছি। হিমশৈল ঢাকা শহরের খণ্ডকাব্য লিখতে লিখতে ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে জ্বালানী। এখন রাজপথে অন্ধকার, পাড়ার মোড়ে মোড়ে নিয়ন আলো নিভে গিয়েছে কবেই। অলিতে গলিতে পায়ের নিচে মরা ইঁদুরের ছড়াছড়ি। কে যেন, কারা যেন বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে দেশজোড়া ইঁদুর। গুদামভর্তি মজুত শস্য আর খেয়ে যায়না কেউ!
পাশের বাড়ির ভারতীপিসি বাকশক্তি হারিয়েছে বহুদিন। সেইযে, একবার হিড়িক উঠল, পৃথিবী ধ্বংস হবে, সেই টেনশানে সেরিব্রাল অ্যাটাক হল পিসির। দুহপ্তা আই সি ইউতে কাটিয়ে ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু হারালো কথা বলবার শক্তি। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার মত ভয়াবহতা ভারতীপিসির মত আর কাওকে স্পর্শ করেনি কোনোদিন। স্বামি পরিত্যক্তা ভারতীপিসি এখন ভাইপোবউদের সংসারে ঘর মোছে, বাসন মাজে, কুটনো কোটে আর ভাইপোবউদের সদ্যোজাতদের ‘পটি’ পরিষ্কার করে। একটা মেয়ে ছিল পিসির, বিয়ে দিয়েছিল। দুটো ব্রোঞ্জের বাউটির দাবিতে গায়ে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।
বুক পুড়ে যাচ্ছে সলতেটার। দাহ্য তেলের বড় অভাব আজ! খননজাত সবকিছুরই বড় আকাল যেন। এই আক্রার দিনে সমস্ত খনিজের বাজারটাই যেন দাহ্য হয়ে উঠেছে। শোনা যাচ্ছে, তেলের বলে বলিয়ান দেশগুলির আমির ওমরাহ্রা আগরবাতি জ্বালিয়ে তার আলোয় নতুন করে হাদিস লিখে রাখবে হৃদয়ের প্রত্নতত্ত্বে।
নিশ্চিত জানি, ভারতীপিসিও ভাবে এসব নিয়ে। চোখের ভাষায় স্পষ্ট হয় ব্যাকুলতা। কনীনিকায় জাল বোনে আদিম নস্ত্রাদামুস। পৃথিবী ধ্বংস হবে। পৃথিবী ধ্বংস হবে। মাছ কাটতে কাটতে মাছের রক্ত লাগিয়ে নেয় জিভের টাকরায়। তারপর হুহু করে কেঁদে ওঠে। পিসির ছেনাল ভাইঝিটি, যে একদিন ছাদ টপকে পৌঁছে গিয়েছিল আমার চিলেকোঠার ঘরে, নাইটি তুলে জাঙের জন্মদাগ দেখিয়েছিল, তার কাছেই শুনেছি, যেদিন রিমঝিম বৃষ্টি হয়, মেঘ ডাকে মুহুর্মুহু, পিসি নাকি পেখম মেলে নাচে, সিঁড়ির তলায়, তার ছোট্ট ঘরটায়।
ভাঙা কাচে কালির প্রলেপ। ফেটে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ভুষোকালির বলিরেখা। দাহ্যতা নয়, দাহ্যতা নয়, শরীরের গোপন বয়স মেপে রাখে লক্ষ্য লক্ষ্য বছরের কার্বনদানারা। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপকে একই সূত্রে বেঁধে রাখে বিশ্বজোড়া কার্বন। পর্ণমোচী বৃক্ষ, চিরহরিৎ অরণ্যের বার্ধক্য মেপে রাখে। প্যাঁচ ঘুরিয়ে বাড়িয়ে রাখি শুকিয়ে যাওয়া সলতে। চিরন্যুব্জ শিশ্নকে ভেঙচি কাটে যেন!
দেখতে দেখতে পঁচাত্তর বছর বয়স হল ভারতীপিসির। ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছি, শ্রাবণসংক্রান্তির দুচারদিন আগে, আকাশ ভেঙে পড়ছিল দুর্যোগে, গর্ভযন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিল ঠাকুমার সই, ও বাড়ির ঠাকুমা। সেদিন বিকেলেই সবুজ লন্ঠনটা কিনে এনেছিলেন ঠাকুরদা। সন্ধ্যাবেলায় আলো জ্বালতেই ডাক এসেছিল ও বাড়ি থেকে। নতুন লন্ঠন হাতেই দৌড়ে গিয়েছিলেন ঠাকুমা। ঘোর দুর্যোগের মধ্যরাত্রে কোনো ধাত্রি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবুও লন্ঠনের আলোয় চোখ মেলেছিল ভারতীপিসি। ঠাকুমার বড় সাধ ছিল, সইয়ের মেয়েকে নিজের ঘরে তোলবার, কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঠাকুরদার সামনে......
লন্ঠন নামিয়ে রেখেছি। জং ধরে গেছে সর্বত্র। তলায় শতচ্ছিদ্র। মনে হয়, কেরোসিন ভরলে আপনা আপনিই গড়িয়ে পরবে দাহ্যতা। তবু একজোড়া বাউটির লালসার থেকে কোনো দাহ্যতায় বৃহত্তর নয়, এই পোড়া দেশে! দহন শুদ্ধ করে এক দেশ, এক জাতি, লক্ষ্য জনপদের তন্ত্রীসঞ্চার। কিন্তু নাড়ির বিশুদ্ধতা! ভারতীপিসি, আমার হতে হতে না হওয়া মা, জ্বলন্ত মেয়েগুলি আমার না হওয়া সহোদরা!
ভারতীপিসি, আমার না হওয়া মা, কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠে। বাসি কাপড় ছেড়ে ছরা মারুলি দেয়। তারপর কুটনো কাটে, বাটনা বাটে, রান্না করে...... এই পঁচাত্তরেও, নিঃশব্দে! বেলা তিনতেই স্নান সেরে কিছু মুখে দেয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতেই নিঃশব্দে ছাদে আসে। ভাঙা রেলিং গলে একটা মোমবাতি রেখে যায় আমার লেখার টেবিলে। আমি বাক্রুদ্ধ হয়ে দেখি, গলে পড়ছে গরম মোম, নাড়ির টান, দেশচেতনা...... ভারতী, মা আমার!!
Comments