সাহিত্য বাজারের হাতে বাংলা ভাষাটার অবস্থা বড়ই করুণ----দীপ শেখর চক্রবর্তী
পাঠক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার একটি পথ আছে। পথটি কঠিন। সামনে বিস্তর বাজে বই। ভালো বই খুঁজে নিয়ে পড়তে হবে। জীবনে সবথেকে বাজে বক্তব্য যেটা শুনেছি, সেটা হল মুড়ির ঠোঙা পেলেও পড়তে হয়। হয় না। মানুষের জীবন তো অসীম নয়। ফলে যতটুকু পড়ব, বেছে ভালো পড়ব। এই বেছে ভালো পড়ার কিছু সূত্র আছে। ক'য়েকজন আছে। যাদের পাঠকসত্তার ওপর আমি বিশ্বাস করি। তারা যা বলেন, চোখ বুজে কিনি। সবই ভালো লাগে এমন নয়। এছাড়া মাঝে মাঝে বিভিন্ন বইয়ের দোকানে গিয়ে উন্মাদ হয়ে যাই। একেকটা বইয়ের কিছুটা পড়ে বুঝে নিই, সেটি আমার জন্য উপযুক্ত কিনা। তবুও আমার বাড়িতে বিস্তর বাজে বই পড়ে আছে। সেগুলোর অধিকাংশ সিলেবাসের পাঠ্যবই। কিছু পরীক্ষা পাশের বই পড়ে আছে।
তবে যা নেই তা হল হঠাৎ বিখ্যাত, হইহই লেখকের বই। যার খ্যাতি ঠিক চারটি মাস। এই চারটি মাসে সে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখকে পরিণত হবেন। সকলে নিজের প্রণাম তার পায়ে রাখবেন। তার একেকটি লাইন নিয়ে বিভিন্ন জায়গায়, গ্রুপে, সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা হবে। এমন বিখ্যাত লোকের বিখ্যাত বইকে আমার ভরসা হয় না।
বই, ভালো হলে তার গন্ধ ধীরে ধীরে ছড়ায়। পাঠক পড়বেন, বলবেন একে অপরকে, তারপর ধীরে ধীরে সেই বইয়ের নাম ছড়াবে। সেই যে ছড়াবে, দীর্ঘদিন থাকবে। সহজে মুছে যাবে না। আর যে বই নিয়ে প্রকাশক প্রথমেই একটা চমক দিয়ে দিতে চাইলেন, তার আয়ু ওই মাস চার। প্রকাশকের দোষ নয়। শুধুমাত্র, গভীর বই দিয়ে প্রকাশনা চলে না।
মানুষ যা পড়ে তাই তার লেখার পথটি গড়ে তোলে। লেখার পথটি ততটা কঠিন নয়। কঠিন হল পাঠক হয়ে ওঠা। সিরিয়াস পাঠক। চোখের সামনে ঘুরছে হৈ হৈ করা বই, নির্জন কবির লাউডস্পিকার গোছের বই, রাম -শ্যাম- যদু পুরস্কার পাওয়া সব বই, রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী প্রায় শ্রেষ্ঠ লেখকের বই, গ্রামের কবির শহরের প্রতি বিদ্রোহ করে ওঠা বই, খিস্তি খেউড়ে নতুন এক বিপ্লব করা বই, অগ্রজ কবির বিপুল স্নেহের পরশ পাওয়া বই, কত কী রয়েছে!
এর মধ্যেও রয়েছে এক একটি অসামান্য বই যা আপনাকে বেছে নিতেই হবে। পড়ে ফেলতে হবে। শিখতে হবে। তবেই লেখক হওয়া যায়। বাদবাকি আর সমস্তই বৃথা।
তবুও মাঝেমাঝে এই হৈ হৈ করা লোকজনকে দেখে মন্দ লাগে না। একটা হুজুগ তো চাই। হুজুগ মনের অসুখ হতে দেয় না। শুধু ভাবি যারা সে'সব হুজুগের বলি হয়। নিজেকে বিরাট হয়ে উঠতে দেখে তাদের কি মন কাঁদে? মনে হয়? এ সম্মানের যোগ্য হয়ে উঠিনি এখনও। জানি না। তবে লেখকের নামই একটা বইয়ের মধ্যে সবথেকে তুচ্ছ। যা প্রধান, প্রতিটি শব্দের ভেতর ভরে দেওয়া তার আয়ু, তার প্রাণ।
এই প্রাণের কাছেই আমি মুগ্ধ হতে পারি। তাই আমি সচেতন একজন পাঠক। যাকে কোনও লজেন্সেই ভোলানো যাচ্ছে না। যাবেও না। এই যে কথাটা বুঝে নিয়েছি। ভালো লেখার জন্য, পড়া ও জীবনকে গভীরভাবে অনুভব করার বাইরে আর কোনওকিছুরই প্রয়োজন নেই।
সকলেরই সবকিছু পছন্দ হবে এমন তো নয়। তবে পছন্দ অপছন্দের বাইরে যে লেখা পরিশ্রমের, যে লেখা সাধনার তা চিনিয়ে দিতে হবে। তবে দেবেন কে? এর উত্তর দিতে গেলেই আবার অপ্রিয় হতে হয়। দেওয়ার মানুষ কিন্তু আমাদের কম নেই। তবে তাদের মধ্যে মৌন মানুষের সংখ্যা এত বেশি। অনেকেই আছেন, তরুণদের করা সবই একেবারে নস্যাৎ করে দিতে চান। তাজমহল দেখে বলেন শহিদ মিনার। এর একটা সুপ্ত রাজনীতি এবং ইনফিরিঅরিটি কমপ্লেক্স আছে।
অনেকেই দেখেছি, অনবরত তরুণদের উৎসাহ দিয়ে যান। এই উৎসাহ-টাই তো জরুরি। নইলে, নতুন কিছু হবে কীভাবে? নতুন লেখা, নতুন পথ, নতুন ভাব-ভাষা। এই জায়গায় যেতে গেলে শুধু পড়াশুনো দিয়ে হয় না। সবকিছু গ্রহণ করার মতো একটি মন চাই। গ্রহণ মানেই যে প্রশংসা নয় সেকথাও মনে রাখতে হবে।
বাংলায় গঠনমূলক সমালোচনা কোথায় হয়? এখন তো শুধু মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা। মুগ্ধতায় ছড়াছড়ি। সকলেই মুগ্ধতা রেখে যান। এই অধিকাংশ তবে সবটা নয়।
আসল প্রশ্ন হল বাঙালি পাঠক কি প্রস্তুত? নিজেদের পাঠঅভিজ্ঞতার বাইরে যেতে। এবার বইমেলায় এত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে বলে যারা নবজাগরণ দেখতে পেলেন, তাদের জিজ্ঞেস করা যায় - কী বই বিক্রি হল?
কবিতার বই বিক্রি হয় না। যদি না আপনি কবিতার থেকেও বড় কবি হয়ে ওঠেন। উদাহরণ নাই বা দিলাম।
গল্পের বইয়ে সুখ দু:খ হাসি কান্না সিরিয়াল পাওয়া গেলে, বিক্রি ভালো হয়।
ইতিহাসকে নতুন করে লেখা কিছু খারাপ উপন্যাস। তার প্রচ্ছদ যত খারাপ, লেখা ততোধিক খারাপ।
এছাড়াও কিছু খুচরো বই আছে। যা আলোকিত স্টল থেকে আলো আলো মায়া মায়া লোকেরা কিনে নিয়ে যান। তাদের দেখলেই মনে হয় এ মেলা নয়, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড।
এর বাইরে কী বই বিক্রি হয়েছে? হয়? আবার অপ্রিয় প্রশ্ন। কেউ কেউ আশাবাদী এসে বলবেন, হয় হয়। আমি বলব, হয় তবে হওয়ার পর তা নিয়ে আর কেউ আলোচনা করেন না। আলোচনা করার জন্য লেখক পত্রিকার দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। ভাগ্যে জোটে কেবলই বন্ধ দরজা।
আমার গল্প লেখার গুরু আলব্যের কামু এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দু'জনেই প্রথম ঔপন্যাসিক। তারপর আসবে মানিক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মহাশ্বেতা দেবী, নবারুণ। আসবে, ফকনার, কার্পেন্তিয়ার, বোর্হেস, মিখাইল বুকগাকভ, শাহীন আখতার, কোজো ল্যাইং, মিলান কুন্দেরা, প্রমুখ। গুচ্ছ নাম বলা যায় বললাম না। এদের লেখা আমার আদর্শ। আমি এদের লেখা পড়ে শিখেছি। বাংলা সাহিত্যেই কারা সব লিখেছেন, লিখে যাচ্ছেন একবার ভাবুন। এখন ক'য়েকজনের লেখা নিয়ে বইমেলায় বিস্তর হৈ হৈ শোনা যায়। আমি কয়েকটি কিনে পড়েছি। দু-তিন পৃষ্ঠার বেশি এগোতে পারিনি। তারা যদি আমার বই কিনতেন এবং পড়তেন, আমি নিশ্চিত তারাও একই কথা বলতেন। মাঝে মাঝে তাদের লেখা নিয়ে এদিক ওদিক কিছু খুকু খোকাদের নাচানাচি করতে দেখি। নাচ, খুব জরুরি জীবনে। তাদের নিয়ে নাচলে আমার বেশ ভালোই লাগে। তবে নাচই জীবন, এ কথাটা তেমন ভাবতে পারিনে। নাচের বাইরে যেটা চাই সেটি হল মেধাবী বিশ্লেষণ। লেখাকে গভীরভাবে বোঝা একটা পড়াশুনোও বটে। ক'জন করেন! সবাই শুধু মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা।
এসবের বাইরে কয়েকজন জরুরি পাঠক আছেন বলে আমি অন্তত নিশ্চিন্তে থাকতে পারি। তারা সৎ ভাবে আমাকে বলেন। তাদের পাঠের ওপরেও আমি ভরসা রাখি। পাঠ মানে প্রশংসা নয়। নিখুঁত সমালোচনা।
যাই হোক, গোটাটাই গয়ংগচ্ছ যেহেতু, এসব কথা ট্র্যাশ। ভালো কখনও নিখুঁত ভালো নয়। মন্দ বলা নিয়েও একটা মত আমরা নেব না। শুধু বুঝব সৎ সাহিত্য এবং অসৎ সাহিত্যের মধ্যে তফাৎটা। গুরুজন, পাঠক, প্রকাশকেরা যদি সবই চমৎকার, দাও দিয়ে দাও একটা পুরস্কারের বাইরে তরুণদের লেখা একটু মন দিয়ে পড়েন, এ ভাষার সাহিত্যটা বেঁচে যায়।
নইলে ন্যাকামি-প্রবণ বাংলা সাহিত্য বাজারের হাতে বাংলা ভাষাটার অবস্থা বড়ই করুণ।
Comments