“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৪

 


কেন জানিনা সেদিনের সেই অনর্গল বলতে থাকা এই বিরাট শহরের কোলাহল থেকে নিঃশব্দে -অন্তরালে কোথাও কোন একটা অদৃষ্ট তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। সেখানে অবাধ উচ্ছাসকে নিজের পরিসরের বাইরে আগলে রাখা যায়। সেই আগলানোর কাজেই অপেক্ষা করে রয়েছে ভবিতব্য। নিজের ফেলে আসা স্মৃতির সঙ্গে কোথাও যে তার এক যোগসূত্রতা তৈরি হয়েছে। এমনকি তা খুব সহজেই অনুকরণীয়, তার একটা পূর্বাভাস লক্ষ্য করা গেল। সেদিনের রাতের পুরো শ্রীকান্ত তাকে নিয়ে গেল এক অজানা দেশে। যেখানে কোন এক গোপন ঘরের কোণে, একটা ছোট্ট প্রদীপের আলো জ্বেলে শাহজিকে অন্নদাদি রাতের খাবার হাতে করে মুখে তুলে দিচ্ছে। চারিদিকের অন্ধকার তখন অনেকটা কেটে গেছে। ভোরের দু'একটা পাখি ডাকছে পাশের বাড়ির বাগানে। বই হাতে নিয়ে কখন নীলাদ্রি ঘুমিয়ে গেছে। ঘরের ফ্যান লাইট সবই জ্বলছে। (তৃতীয় পর্ব থেকে কিছু অংশ)

কলেজ শুরু হতে হতেই ওর বেশ একটা সময় কেটে যেতে থাকল । ওর শহরের অনেক বন্ধু-বান্ধবও নিজেদের শহর ছেড়ে এই কলকাতায় পড়াশোনার জন্য এসেছিল । সবার সঙ্গেই ও যোগাযোগ রাখত । রাখার কারণ, সবার সঙ্গেই ওর একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল । তাছাড়া বাইরে থেকে কোন ছেলে যখন কলকাতা নামক এই শহরের বুকে পা রাখে, তখন এই বড় শহরটা যেন তার অনেকটা একা একা লাগে । পরিচিত সমাজ-সংস্কৃতি-সংস্কার-বাড়ি-ঘর-চেনা রাস্তা এগুলো সব ছেড়ে আসতে অনেকটা মন কেমন কেমন করে। এই শহরের নিজস্ব একটা ছন্দ,একটা ঐতিহ্য আছে,দীর্ঘ ইতিহাস মিশে আছে রাস্তায়-ফুটপাতে আর বড় বড় অট্টালিকায়। এই শহরের মধ্যেই থাকে কত অজানা সম্পর্কের ইঙ্গিত।

বেশ কিছুদিন পর নীলাদ্রির মা-বাবা এল বাড়িতে । ছেলের পড়াশোনার যাতে কোনরকম ত্রুটি না হয়,তা সে থাকা থেকে খাওয়া পর্যন্ত। প্রথম প্রথম নীলাদ্রির কোনও রকম চিন্তার বিষয় বলে কিছুই ছিল না। শুধুমাত্র পড়াশোনা যাতে মন দিয়ে করতে পারে এমন একটা ভাব সে সব সময় বজায় রাখত। ছোট্ট দিদার বাড়ির বাইরের ঘরই তার হয়ে উঠল একটা যজ্ঞের ঘর। বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে ও কোনোদিনই তেমন কোনও পড়াশোনা করেনি। এই সময় এসে যেন একটা আলাদা আগ্রহ বাড়তে থাকল। কলেজ স্ট্রিটে হাফ দামে বই পাওয়া যায়,এটা জানার পর থেকেই ওর কেমন যেন কমদামী বইয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ বেড়ে যেতে থাকল। প্রতিদিনের কলেজ যাতায়াত,খাওয়াদাওয়া এসব কিছুর জন্য মাসিক খরচ বাবা ওকে দিতে থাকল। কলেজ জীবনের প্রত্যেক ছেলেমেয়েদের এইটা একটা বড় পাওয়া। সে সময় হয়তো ওরা অনেক কিছু ভাবে,এই সময়টায় বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা একটু স্বাধীনতার ফুরসৎ পায়। এমনই অবস্থা হয়ে দাঁড়ালো নীলাদ্রির। এখানে নিজের কথাবার্তারও একটা পরিবর্তন হয়ে গেল। সাধারণত কলকাতার বাইরের ভাষা একটু অন্যরকম। যেকেউ খুব সহজে ধরে নিতে পারে,যে ব্যক্তি বাইরের। অর্থাৎ তার জন্ম কলকাতায় নয়। আর তাই কলকাতার আদপ কায়দাও শিখতে হল তাকে। প্রথম প্রথম জীবনের সবকিছুই ভালো লাগে, এই প্রতিদিনের যাতায়াত। সাইকেল করে প্রথমে খেয়াঘাট। তারপর আবার ট্রেন। তারপর শিয়ালদার ব্যস্ততা কাটিয়ে ভিড় থেকে ধাক্কাধাক্কি করে কলেজে পৌঁছানো। নির্দিষ্ট সময়েই তার কলেজে চলে আসা নিত্য দিনের হয়ে উঠেছিল।

একটা অদ্ভুত পরিবর্তন জীবনের সঙ্গে নিজের। প্রতিদিন সকালে উঠে স্কুলে যাওয়া আর এখানে সকালে উঠে প্রায় পঞ্চাশ কিমি দূরে কলেজে যাওয়া একটা বিরাট ব্যাপার। তাই নিজেকে অন্যভাবে তৈরি বা প্রস্তুত করাটাও প্রয়োজন হয়। নীলাদ্রির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু হলনা। এদিকে নীলাদ্রির মায়ের স্বভাব-আচরণ ছিল একটু অন্য গোত্রের। খুব সহজে কারোর কাছে মাথা নোয়ানো তাঁর নীতি বিরুদ্ধ কাজ বলেই মনে করেন। তাই স্থানীয় হোস্টেলে থেকে ছেলের পড়াশোনা চালানোর কথা বললে,বাড়ির সর্বকর্তৃত্ব ওর দিদার কথা মতোই সে ছোট ঘরে থাকতে শুরু করে। প্রথমে ওর মা তাতে সায় না দিলেও, পরে সবার অনুরোধে ছেলেকে ওখানেই রাখতে বাধ্য হয়। এভাবেই থাকতে থাকতে সাধারণ মানুষ থেকে লোকের কাছে একটু একটু করে পরিচিতি ওর বাড়তে থাকে। প্রতিদিনের কলেজের কাজ নিজের মতো করেই রাত জেগে চলতে থাকে। কলেজের পড়াশোনার চাপও একটু একটু করে বাড়তে থাকে। এই প্রথম কলেজেই ও জেনেছিল লাইব্রেরিতে এখানকার অনেক ছেলে মেয়ে পড়তে আসে। তাছাড়াও অনার্সের ছাত্র মানে অন্যদের থেকে একটু বেশিই পড়াশোনা করতে হয়। একটু বেশি জানতে হয়। ক্লাসে একদিন এডুকেশন ক্লাসের এক প্রফেসর পূর্ণিমা ম্যামকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ম্যাম আমরা অনার্স ওই নাম টা কেন পাই ?' উত্তরের, মুখে চাপা হাসি নিয়ে ম্যাম বলেন, আসলে তোমরা এক একটা ওনার্ড। অর্থাৎ অনারেবল। বুঝতেই পাচ্ছ, তাহলে তোমাদের অন্যদের থেকে সাধারণ মানুষ একটু অন্যভাবেই দেখবে। তোমরা সবার থেকে একটু বেশি জানবে। একটু বেশি চর্চা করবে। অনেকটা বেশি সময়ধরে তোমাদের চিন্তা-ভাবনা বা কাজ-কর্মের প্রতি একটা ঝোঁক থাকবে। তারজন্যই তোমরা অনার্স পড়ছ। এই প্রথম কেউ এতো ভালো করে বোঝাতে পারে,ওর এই প্রথম জানা হল। এই কথা প্রসঙ্গেই পূর্ণিমা ম্যাম, তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি লাইব্রেরি যাও? কী কী বই পড়ো? এই প্রশ্নগুলো অনেকটা চমকেই দিল। সত্যিই তো লাইব্রেরি তো কোনদিন যায়নি সে। স্কুলে লাইব্রেরি ছিল, কিন্তু সেটা তে তো কোনোদিন যায়নি সে। শুধুমাত্র বছরের শেষে লাইব্রেরি নামক নামক একটা ফি দিয়ে এসেছে, এই যা। সেদিন ম্যামই ওকে বললেন,যে ওদের কলেজেরই লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ কার্ড করে নিতে। 

কথা শুনেই সেদিন নীলাদ্রি সোজা চলে গেল নিচের গ্রাউন্ডে। সেখানে কলেজের আই-কার্ড দেখে আর কিছু কাগজপত্রের প্রমাণ দেখে মেম্বারশিপ নিল। যদিও একটা সমস্যা হল কলকাতা অর্থাৎ সাত লক্ষের কোড ছাড়া বাড়িতে বই আনা যাবে না। এই মর্মে আবার ওর দুই বন্ধু সঞ্জয় ও অভিষেক দুজনেরই এর আওতায়, তাই তাদের হয়ে গেল। এই প্রথম লাইব্রেরির একটা বিষয় সে জানল, টা হল, একটা রেফারেন্স বই আর একটা লেন্ডিং বই। সত্যিই শেখার ধাপ কীভাবে একটা ছোট্ট জীবনকে কতটা বদলে দেয় থেকে থেকে। সাধারণ এক মফস্বল থেকে আসা ছাত্র। যার চিন্তার জগৎ ছিল মাটিমাখা। ভাবনার স্তর ছিল হালকা। সেই কীভাবে একটু একটু করে পুঁজি সঞ্চয় করে তাই হল দেখার।

এভাবেই ওরা তিন মূর্তি কলেজ শেষ করে প্রতিদিন লেবু তলা পার্কে যেত। নানান কথা। নানা আলোচনা। একটা লম্বা বেঞ্চে তিনজন বসে থাকত। তিন জনেই তিন জনের কত কথা বলত। নীলাদ্রি এখানেই একটা বিরাট আকাশ পেল। এখানে উন্মোচন হওয়া যায় নির্দ্বিধায়। এখানে হাতে হাত ধরে সঙ্গী হয়ে বাঁচা যায়। এমনই এক অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরল। 

এরই মধ্যে ঠিক হল ওরা বিবেকানন্দ লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ নেবে। নিতে হলে সন্ধের সময় যেতে হবে।এদিকে নীলাদ্রির আবার বেশি রাত করে বাড়ি ঢোকা বারণ। একদিন যায়। দুদিন যায়। অভিষেক ও সঞ্জয়ও ওর জন্য অপেক্ষা করে করে বেশ কিছুদিন পার করে ফেলে।একদিন অভিষেক বলল, তুই আজ করে নিয়ে আমার বাড়ি থেকে যাস। তোর বাড়ি ফিরতে রাত হলে বাড়িতে বকাবকি করলে,ফেরার দরকার নেই। এদিকের কাজ টাও হয়ে যাবে। আর ওদিকে ঝামেলাও মেটানো যাবে। ওই প্ল্যান করেই একদিন কলেজ শেষ করে লম্বা হাঁটা। শিয়ালদা থেকে বিবেকানন্দ রোডের বিবেকানন্দ লাইব্রেরি। সন্ধে সাতটা। কাগজ পত্র সব জমা হল। এরপর আবার হেঁটে হেঁটে উল্টোডাঙ্গা স্টেশন হয়ে সঞ্জয় ট্রেন ধরে নিল। আর নীলাদ্রি আর অভিষেক হাঁটতে হাঁটতে এলো ২৫৪ মানিকতলা মেইন রোড। যা পরবর্তী জীবনে নীলাদ্রির একটা ছদ্মবেশী ঠিকানা হয়ে উঠেছিল।

Comments

Anonymous said…
খুব সুন্দর এগোচ্ছে।

আরও পড়ুন

সৌমাল্য গরাই

কবিতা সিরিজ

কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৮

একটি কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ২

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৬