আলো ছায়া —সুদেষ্ণা ব্যানার্জি
অলংকরণ–বিজয় দাস |
কোনো কোনো গল্প আধভাঙা থেকে যায়, শেষ হয়েও হতে চায়না। চরিত্রগুলোর ঘুষঘুষুনি জ্বর কাটতেই ক্রুদ্ধ জলের স্রোতে ভেসে যায় গল্পের নৌকো। আকাশ থেকে খসে পড়ে ইতিহাসের শোক মোচনকারী বিষণ্নতা। স্মৃতির ভুবনডাঙ্গায় মেঘ করে আসে। প্রতিটা আত্মার সাথে খেলা করে অসময়। কর্ম ব্যস্ত জীবনের বাইরে ও ভেতরে লেগে থাকে বিকেলের অমসৃণ বাতাস। আত্মার কুচো টুকরোগুলো কাজ না পেয়ে মুখোমুখি বসে থাকে হুল ফুটিয়ে। হাওয়া ভাঙে মেঘ ।বাদ বাকি যা কিছু সব অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়ায় জাদুঘরের ঘড়ির ভিতরে। ছাতিম গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রেম। কখন যে গল্পের মোড় ঘুরে যায় টের পায় না চরিত্ররা। ক্রমে সব দৃশ্য ,পথ ও মানুষ মুছে যায়। কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে যায় দুটো মূর্তি। জীবনের ঘেরাটোপে বস্তুত চুরি হয়ে যায় সুডৌল সম্পর্ক। উড়ে যায় প্রজাপতি। বিষণ্নতার কাছে মুক্তি মূল্য পেয়ে যায় সময়। সব ধ্বংসের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম থেকে যায় কেবল। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা বিশ্রাম। বেদনাহত মাছি প্রাগৈতিহাসিক পান্ডুলিপির বিছানায় ঘুমিয়ে মরে।
থেমে থাকা মানে তো হেরে যাওয়া নয়; তাই এক গল্পের মধ্যাহ্নে শুরু হয় আর এক ঘুম ভাঙা গল্প। প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা নতুন প্রবাহ পায়। এবার বেশ তেজী স্রোত যাতে মেঘলা আকাশে চলে পৃথিবীর উল্টো পরিভ্রমণ। গাছের মাথা খুঁজে পায় প্রেম। কুয়াশায় ঢাকা আদিম কোন দ্বীপের চারপাশে যেন ছড়িয়ে থাকে যোজনব্যাপী আমিষ গন্ধ।কেটে যায় কয়েক বসন্ত। সর্বনাশের কাছে সৃষ্টি হাঁটু গেড়ে বসে। প্রেমের দরজায় ধাক্কা মারে অবিশ্বাস; থামের মতো পথ রোধ করে দাঁড়ায় উচিত-অনুচিতের আংশিক বিপর্যয়। পাশের চেয়ারে এসে বসে বেদনা। ভালবাসার কোন জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।আলোর কাছাকাছি গেলেই তুষারপাত হয়। অন্ধকার ভালোবাসি বলে আয়নায় মুখ দেখতে পাই না। জীবনানন্দের বিদগ্ধ নগরে সেই কবেই হাতেখড়ি হয়েছিল "প্রেম" নামক দূষিত বায়ুর। আজকাল বাস্তব ছেড়ে বেরতে গেলে পায়ে কাঁটা ফোটে। গোড়ালিতে ব্যথা হয়। চোখে আলো পড়লে বিরক্তি বোধ জন্মায়। তবু কারা যেন আলো দেখায়! তাদের হাতটা শক্ত করে ধরি। হারিয়ে যাওয়ার ভয় বড় মারাত্মক!
শীতের রুক্ষতাকে জব্দ করতে বসন্ত আসে বটে কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে আসে নানা রোগভোগ। প্যারাসিটামল কিনতে গেলে দোকানে ওষুধ ফুরিয়ে যায়। দোকানদার কেমন যেন আলোর ব্যবসায়ী হয়ে যায়। ঝোড়ো হাওয়ায় রুক্ষতা সজীব হয়। দিনকে দিন বয়সের পাখা গজায় পিঁপড়ের মতো। তবু মানুষ বোকা আর পিঁপড়ে চালাক।
যে মানুষ প্রেমিকার চোখে চোখ রাখতে পারে না সে প্রতিদিন তার ঘরের আয়না মোছে শিরীষ কাগজ দিয়ে। রাতে শুতে যাবার আগে ভালো করে তৈরী করে নেয় পরবর্তী চিত্রনাট্য। প্রেমিকার বারান্দা জুড়ে সারাদিন খেলা করে শীতের ঝকঝকে রোদ্দুর। কাঁচের মতো রোদ ঠিকরে দেয় নরম কবোষ্ণ গাল। গালের চামড়ায় পরিচিত আঙুল দাঁড়ি টানে নিঃশব্দে। সে জানেও না একদিন এই সত্যের চেয়ে আর বেশি কিছু দাগও কাটবে না অবসর যাপনে। সে পা মেলে দেয় শীতের রোদেলা উষ্ণতার কাছে। পা ছুঁয়ে ওম নামে চোখের বলিরেখা ধরে। দৃষ্টি স্থির। উষ্ণতা হৃদয়ে পৌঁছানোর আগেই প্রবল শীত জড়তা দিয়ে জড়িয়ে ফেলে সমস্ত অনুভূতি। ভালোবাসা এই জায়গায় ধ্রুবক নয়। সম্পর্কটা ধোঁয়া হয়ে যায়। আত্মীয়তা প্রায় বিলীন হয়ে পড়ে। সেই ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে সরে যায় স্টেশনের মতো। প্রেমিকা হয়ে যায় শহরের পরিত্যক্ত ট্রামলাইন।
এরপর জলীয়বাস্প ঘিরে ধরে চোখের পাদদেশ, গলার স্বর। লেপ তোষকে মোড়া কথার পিঠে কথারা যায় জমে।পরের শীতটা হয়তো আরও কিছুটা সংযত হবে। অনুপম নতুন করে গান লিখবে শীতের যত্ন আত্তিতে। চিরপরিচিত বোরোলীন কাটা ছেঁড়ার যত্ন নেবে যতটা সম্ভব। বাকি প্রলেপ লাগাবে অফুরন্ত সময়.......
কোনো কিছুই স্থবির নয় এ পৃথুলা পৃথিবীর বুকে। সঞ্চিত যা কিছু সবই হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। অভ্যেস বদলাতে থাকে। বেঁচে থাকাটুকুই আসল। তবু চলে যেতেই হয়। আজলকাজল অন্ধকারের বিনুনি বেয়ে নেমে আসে সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের যৎকিঞ্চিত আয়োজন। চলে যাবার বেলায় এসব কিছুই নিয়ে যাব না। পাশে পাশে ফুটে থাকবে চাঁদফুল। তারাদের ডিঙিয়ে পৌঁছে যাব চিরকাঙ্খিত সে নগরে। তোমাদের জন্য ছুঁড়ে দেব আমার মায়ার চাদর।যে চাদর বহুকাল আগলে রাখতে চেয়েছি বুকের ওমে তার প্রতি সব অধিকার ছেড়ে যাব তোমাদের জন্য। যে ভিক্ষের পাত্র হাতে নিয়ে ঘুরেছি একদিন তা উপুড় করে দিয়ে যাব তোমাদের বন্ধ দরজার সামনে। নাহ , সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশটুকুও তোমরা পাবে না। শুধু যাপন করতে পারবে ঝলমলে রোদের দিন; যাপন করতে পারবে আমার কবিতা। এর বেশি কিছুর খুব প্রয়োজনও তো নেই! যে রাতেরা ঘুম কেড়ে নেয় ছিনতাইবাজের মতো সেই রাতের জরায়ুর অভ্যন্তরে জন্ম নেয় কত বিচিত্র অনুভূতি। কত অলস চাহিদা ঘূর্ণির মতো পাক খায় মস্তিষ্কের জলে। সেখানে পা ডুবিয়ে বসে থাকি অন্ধ হব বলে। আর যতবার অন্ধ হবার চেষ্টা করি ততোবার চোখ খুলে যায়। চোখ খুলেই দেখতে পাই আমাকে ব্যবহারের আজব পন্থা। জন্মাবধি যা কিছুকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছি , যা কিছুতে পা দিইনি স্রেফ পড়ে যাবার ভয়ে তাই যেন পা আটকে রেখেছে কি নিরুপম ঔদ্ধত্যে।
আজ আর থেমে থাকতে পারি না সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। জানি চলে যেতেই হবে। এই তো দস্তুর মানুষের, সম্পর্কের। যতটা প্রবল আমাদের চাহিদা তারচেয়েও সত্যি চলে যাওয়া। বোধিসত্ত্বের গল্পগুলোও আজগুবি মনে হয় আজ। বোধ আর নির্বুদ্ধিতার বেড়াজাল টপকে যারা বেরোতে পারে তারাই জয়ী হয়। মানুষ হারতে ভুলে গেছে, শুধু জেতার নেশা। এই জেতার তাগিদে হারিয়ে যায় প্রিয় মানুষ, প্রিয় সম্পর্ক, প্রিয় মুহূর্ত। যাদের কাছে হাত পেতে ভালোবাসা কুড়োতে চেয়েছি তাদের দিয়ে যাব কিছু অকালশ্রাবণ, কিছু বৈপ্লবিক শীত আর না ফিরে আসা বসন্ত।
চলে যে যেতেই হয় ......কোনো এক নিশিথে সব বন্যতা অবহেলা করে যাব। অস্তিত্বের শূন্যতাকে মেনে নেব তেমন পাষাণ আজও তো হতে পারিনি। এই তো নিজস্বতা, উপমাহীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এটুকুই তো সম্বল.....
"এ যদি হয় সত্তা তবে অস্তিত্বের মানে থাকা,কেবল থাকা,তুমি বিশ্বগোচর থেকো"।
এটুকুই তো যাবার বেলা চাওয়া ...
আঁধার যাদের স্নেহাতুর আশ্রয়ে রাখে তাদের ঘরে ওই নীলবাতিটুকু জ্বেলে দেওয়াও বিলাসিতা। সন্ধ্যের গুঁড়ো নির্দিষ্ট বাসস্থানে মনে করায় প্রিয়তম ছাদের কথা। যে ছাদ আশ্রয় দেয় সেই ছাদ খোলা আকাশের নীচে দাঁড় করিয়ে একতারা শোনায়। কারো বুকে মুখ লুকিয়ে মানুষ নিজের নাম শোনে নিঃশব্দে। চোখ বেঁধে দেয় এক গুচ্ছ নিশাচর তারা। কালপুরুষের বুক চিরে নেমে আসে কাল্পনিক অবয়ব। ছঁুয়ে দেয় সিঁথির অগোচর আবেগ। চুপটি করে প্রেমিকা হয়ে যাই ভাবুক চাঁদিয়াল আকাশের নীচে। হয়তো কোনো প্রেমিক নাবিক জাহাজের মাস্তুল সাফ করছে দূরদেশে যাত্রা করবে বলে! পৃথিবী ও তারাদের আলোকবর্ষ দূরত্ব নেমে আসে দুটি মানুষের মধ্যিখানে। পরিস্কার হয়ে যায় বিলাসিতার গন্ধ ঠিক কতটা ক্ষণস্থায়ী! অনুভূতির নিছক বিলাসিতা মানুষকে ভিখারী করে; আর এই ভিখারীকে যখন কেউ হিংসে করে তখন তার প্রতি করুণা জন্মায়। করুণা হয় তার হিংসের মাপকাঠি দেখে।ক্ষণস্থায়ী যা কিছু তাকে বৃথা আগলে রাখার চেষ্টার চেয়ে মূর্খামি তাকে হিংসে করাটা। তুমুল দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতে থাকে কল্পনার জঞ্জাল। পতঙ্গভুক উপজাতির থেকেও নিরক্ষর এই বিলাসিতাপ্রবণ মানুষ। বুকের মধ্যে দীঘির মতোন উচাটন নিয়ে দিকভ্রষ্ট হওয়াই এদের প্রধান উদ্দেশ্য......না বাঁচতে পারে নিজের খেয়াল-খুশি মতো ; আর না পারে বেঁচে থাকা থামাতে। সবটা উপুড় করে দেওয়ার পরও খামতি কিছু না কিছু থেকেই যায়। সেই থেকে যাওয়া খামতিটুকু চিহ্নিত হয় অপারগতা হিসেবে। সে ঘড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে ততো। হৃৎপিণ্ডে তখনও হামাগুড়ি দেয় গোটাকতক প্রেম। জমতে থাকা আগুনের ব্যবহারে পুড়ে যায় গলা। আবার হাঁটতে থাকে স্বপ্ন বরাবর। ফাঁকফোকরে বাসা বাঁধে সদ্য প্রস্ফুটিত আকাঙ্ক্ষা। নেশাগ্রস্ত আলোর নীচে জেগে ওঠে বস্তাপচা আবেগ। ভুলে যেতে থাকে আবেগের অপর নাম বিলাসিতা। গলার কাছে লোভ পাক খেতে থাকে ঘূর্ণির মতো, বমি হয়ে উঠে আসতে চায়। বিলাসিতার লোভ মারাত্মক রকমভাবে অন্ধকারের সমীকরণ বোঝানোর চেষ্টা করে। আঙুলের ফাঁক থেকে কবেই আঙুল বেরিয়ে গেছে খেয়ালে আসে না। আত্মার পচা কথোপকথন নিয়ে বিপথগামী বিমান আসে। রিংটোন যায় ভুলে...
আরো পড়তে—
Comments