“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৫




আসলে তিন বন্ধুর মধ্যে অভিষেক অনেকটা হয়ে উঠেছিল কাছের। যেহেতু অভিষেকের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় নীলাদ্রি থাকত। কলকাতায় কলেজ। আবার কলেজ শেষে ট্রেনে করে যাওয়া অনেক সময় খুব সময় সাপেক্ষ হয়ে যেত,তাই মানিকতলা রোডের বাড়িতেই ছিল ওর থাকা। এই থাকতে থাকতে কত কথা,আলোচনা বা নিজেদের মতো করেই সময় কাটাত দুজনে। প্রকৃত বন্ধু পাওয়াটা সত্যিই অনেক ভাগ্যের- এমনই মনে করত, মাঝে মাঝে নীলাদ্রি। কেননা গ্রাম থেকে আসা কোন ছেলের পক্ষে কলকাতা নামক এই বিরাট শহরের ছায়ায় সুযোগ থাকে কম। আলিঙ্গন অপেক্ষা ঠকানোর কাজ থাকে বেশি। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ওর এমনটা হলো না। একটা সময় থাকা খাওয়া সবই এই মানিকতলার বাড়িতে হতে থাকল। কলেজে তিন জনে সব সময়ের জন্য এক হয়ে থাকত। কলেজের সময় লাঞ্চ টাইমে ওরা তিন জনে প্রায় চলে যেত লেবুতলা পার্কে।যার অন্য নাম সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। সেদিনের সব স্মৃতি মনেপড়ে যায় ওর আস্তে আস্তে।

কলেজের পড়ার চাপ বাড়তেই থাকল। বইপত্র,যাতায়াত। এ লাইব্রেরি থেকে ও লাইব্রেরি। আবার সেখান থেকে অন্য লাইব্রেরি এভাবেই বাড়তে থাকল পড়াশোনার ব্যস্ততা ও চাপ। কিন্তু এই চাপ জোগানোর জন্য দরকার টাকা। মাসে মাসে ওর বাড়ি থেকে যে টাকা আসত, তাতে তেমন কিছুই হতো না। টিফিনের সময় ওরা তিন জনেই অনেক সময় শিয়ালদা আসত। ওই অঞ্চলে ছোট ছোট ঘুমটি যারা কম পয়সায় অনেক সস্তার খাবার বানাতো ও বিক্রি করত। এমনই একটা গলি,স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা বৈঠক খানার কাছে উঠত। ওরা বলত বিহারীর দোকান। ওখানে খুব সস্তায় পাঁচটাকায় পাওয়া যেত দুটো সবজি দেওয়া রুটি। সবজি বলতে সয়াবিনের তরকারি। খাওয়া শেষে নীলাদ্রি টাকা বার করে দেয়ার উদ্যোগ করলেই, সঞ্জয় বা অভিষেক দুজনেই বলত,রাখ রাখ আমরা দিচ্ছি।এই আন্তরিকতায় প্রথম ও দেখল কলকাতা শহরের গলি থেকে। শহরের গলি নীলাদ্রি অনেক ছোট বেলা থেকেই চিনত। মামার বাড়ির সূত্রে ওর এই গলি গুলোর একটা চেনা ছবি স্মৃতিতে অনেক অনেক দিন পর্যন্ত থেকেই গেছে।এভাবেই বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। প্রতিদিনের কলেজ যাওয়া-আসার খরচ পাতি আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল। কিন্তু এমন সময় একটা অনভিপ্রেত ঘটনা যে তার জন্য অপেক্ষা করেই রয়েছে,তা কে জানত। বনেদিয়ানা বজায় রাখা যে একটা বিরাট ও মৌলিক কর্তব্য তা ওর মা খুব ভালো করেই আত্মস্থ করেছিল। তাই মামার বাড়িতে থেকে নিচের ছোট ঘরটায় পড়াশোনা করবে,এইরকম একটা সিধান্ত শেষমেশ ঠিক হলেও,ওর মা কিন্তু এই ব্যাপারটাকে একটু অন্য ভাবেই দেখার চেষ্টা চালিয়ে ছিল। সেজন্যই স্থানীয় পেয়িং গেস্ট বা কোন ভাড়া জাতীয় কিছুর একটা পরিকল্পনা তিনি করেই নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাঁধ সাজল সময়। সেই বাড়িতে ওর দুই মামা থাকত। বড় মামার এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ের বহুকাল আগে বিয়ে হয়েছে,সে এখন শ্বশুর বাড়ি। ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এখানে যেহেতু ও শুধুমাত্র পড়ার কাজটুকুই করতে এসেছে,যে ওটুকুই মন দিয়ে ও করতে পারবে। তারজন্য তাকে বাইরের ঘরটা ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছে। এই ঘরে থাকা নিয়ে একটা দোটানা ছিলই। কেননা সেই ছোট্ট ঘরটা অন্য কাউকে ভাড়া হিসেবে দিলে তাতে কিছুটা আয়ও বাড়ত। তাতে দুই ছেলের হাত থেকে মা'কে চালানোর কিছুটা বোঝা নামত। কিন্তু সে আর হলো কোথায়। নীলাদ্রির মা-বাবা তখন এখানে ওর সঙ্গে থাকতেন না। তারা থাকতেন দেশের বাড়িতে। মাঝে মধ্যে ছেলেকে দেখতে আসার দরুণ বেশ কিছুদিন থেকে যেতেন তারা। ওদের মামার বাড়িতে ছোটমামা বরাবরের একটু অন্যরকম। খুব সহজে মিথ্যের দ্বারা কীভাবে স্বার্থ কায়েম করতে হয় তিনি জানতেন খুব ভালো করেই। ছোট বড় নানা ঘটনার মধ্যে দিয়েই খুব সহজে বোঝা যায়।

এবাড়িতে থেকেই নীলাদ্রি অনেক কিছু দেখেছিল। একটা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক। একটা মা-ছেলের সম্পর্ক। বিবাহিত ছেলে বউয়ের সঙ্গে বৃদ্ধা শাশুড়ির সম্পর্ক ও জীবন।আসলে আচার-উপাসনা নিয়ম নীতির বেড়াজালে ওর দিদা একদম ছিলেন নিষ্ঠাবান। সকালে উঠে তাঁর শুধুমাত্র দরকার ভালো একটা কড়া করে চা। সেও সময়ের সঙ্গে ঘুচে গেছে। আর এই ঘুচে যাওয়া আচার আচরণ যাতে মা' অর্থাৎ ওর দিদা যাতে ঠিকঠাক পায়,তারজন্যও অনেকটা সাপোর্ট হিসেবে নীলাদ্রি যেন এখানেই থাকতে শুরু করেছিল। আসলে অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই আসল লড়াই। ছেলে বউয়ের যে আদর-সেবা-যত্ন ছিল না,তা নয়। ছিল তবে সেটা ঠিক সেবা না তাচ্ছিল্য, সেটা খুব সহজেই জানা গেল,যখন আস্তে আস্তে দিদার সন্তান হয়ে উঠতে থাকল নীলাদ্রি নিজেই। সকালে প্রতিদিন কলেজ যাবার সময় নীলাদ্রির ছোট মাইমা ওকে ভাত দিত।অনেকটা রাত জেগে পড়াশোনার জন্য সকালে কোনও দিনই উঠতে পারতনা। তাছাড়াও মফস্বলের ছেলেরা সাধারণত অনেকটা ভোর ভোর উঠতে পারে। ব্যতিক্রম শহুরেবাসীদের। কিন্তু নীলাদ্রির ক্ষেত্রে ছিল উল্টো। তাই সকাল আটটায় ওর ভাত রেডি হয়ে চলে আসতো বাড়ির নিচের বারান্দায়। আর সঙ্গে ঢাকা থাকত ওর দিদার জন্য ওর মাইমার তৈরি চা। কি আশ্চর্য না।ভাতের পাশাপাশি পড়ে থাকত চা।

এখানে একটু অন্য কথা বলি। এই ভাত দেওয়ার ঘটনা।আসলে এখানে নীলাদ্রি থাকবে এটা ঠিকই। কিন্তু ওকে খেতে কে দেবে? টানাটানির সংসার ওর দুই মামার। তাই ওরা দিদাকেই খাবার দিতে পারতো না। একেই গোদ, তারওপর বিষ ফোঁড়া। তাই যেদিন প্রথম ওর মা বলল,দাদা তুমি তাহলে ছেলেটাকে খাবার দিও,আর একথা বলেই হাতে মাসের আপাতত হাজার খানেক টাকা গুঁজে দিল।লজ্জা বা সমমানের খাতিরে নেওয়া যায়না। মানে না নিয়েই বা উপায় কী। তাই প্রথম বারের জন্য ওর বড় মামা টাকাটা নিয়েছিল। এইরকম ছোট একটা ব্যবস্থা করে ওর মা-বাবা আবার দেশের বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু বিপদ দেখা দিল তারপর। বড়মামাকে ওর মা মাসিক একটা খরচ আপাতত দিয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু তারা সকাল বেলায় প্রথমদিন খাবার দিল না। এদিকে যথারীতি ও সকালে উঠে ব্রাশ সেরে নিয়েছে এবং দিদার জন্য চাও রেডি করছে।কেননা,দিদা মূলত বেলায় বিছানা ছাড়ে। তাও অন্তত বেলা এগারো টা। আর টেবিলে চা টা চাপা দেওয়া অবস্থায় থাকত ওই এগারোটা পর্যন্ত। সেই সময় সকাল বেলায় উঠে দিদার বাথরুমের বিরাট একটা অভ্যাস ছিল। যদিও ওটা আস্তে আস্তে বড় অভ্যাসে পরিণত হয়।কে ননা তিনি বাথরুমে যেতেন আর বেরোতে বেরোতে প্রায় দু'ঘন্টা।এইসময় বাড়ির কারোর কোনও রকম দরকার হলে,যতক্ষণ না তিনি বেড়চ্ছেন,ততক্ষণ রক্ষে নেই। এ এক অদ্ভুত বদ অভ্যাস। নিজের দিকে থেকে তার হয়তো একাজ করতে কোনরকম চিন্তা বা খারাপ বা ইতস্তত লাগত না,কিন্তু বাড়ির বাকিরা পড়ত মারাত্মক ফ্যাসাদে। এভাবেই চলে আসছে। চলছে দীর্ঘদিন। তবে ওরাও একরকম এই কথা বা অসুবিধার কথা বললেও,তিনি একটা ঔদ্ধত্য নিয়ে বলতেন,যাঁর পছন্দ হবে এ বাড়িতে থাকবে,যাঁর হবে না তাঁরা বেরিয়ে যাবে। এও একরকম ছেলে বৌদের ওপর তাঁর অভিমানবশত অভিশাপ। তাই,আর নতুন করে তার এমন চরিত্রের ওপর আর কেউ কথা বলত না। এই পুরো চলে আসা নিয়ম বা এই কাজটাকে ওরাও খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে,প্রায় এক গুঁয়েমি ভাবেই রেখে দিয়েছে।

আসলে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মান অভিমান, আকুতি-নিষ্কৃতি এসব কিছুই চলে মুষ্টিমেয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে। বাড়ির বৃদ্ধা মা কিন্তু প্রতিদিন বেলা এগারোটায় চা খেতে বসেন। অথচ বাড়ির বউরা কেউ সে সময়ে তাঁকে একটা চা করে দেননা। বিপরীতে সেই সকালে তৈরি হওয়া চা পরে থেকে থেকে ঠাণ্ডা হয়ে জুড়িয়ে যায়। আবার সেই ঠাণ্ডা চা নিয়ে বাথরুম থেকে গায়ে কোমরে গামছা দিয়ে বাড়ির সিঁড়ির নিচে একটা স্টোভে গরম করত।সেই স্টোভও যেন শত বছরের পুরনো। সেখানে আবার তেল যেন যায় যায় অবস্থা। একটা দেশলাই কাঠি ফেলে ওর দিদা ঘরে ঢুকে যেত। ভিজে কাপড় ছেড়ে। ঠাকুরকে একটু জলমিষ্টি দিয়ে,একটা ধুপ জ্বালিয়ে সারা বাড়ি দেখতো।সেই ধুপ জ্বালাত স্টোভের আগুন থেকে। তখন সবে তেলের স্টোভের আঁচ অনেকটা বেড়েছে। চা একটু একটু করে ফুটতে থাকল। এই ঘটনায় গ্রাম ছেড়ে আসা ছেলের বিবেচক মনকে নাড়া দিয়েছিল। তাই নিজেই একরকম নিজের মতো করে,দিদাকে চা করে দেওয়ার মনস্থির করেছিল। তাই সে চা করে দেবে। আজ সে একটু লেটেও কলেজ যাবে। অথচ সকাল দশটা বেজে গেল এখনো ওপর থেকে ভাত এলো না। বড়মামারা কি ভুলে গেল? এবাড়িতে সে নতুন। আর যাইহোক প্রথম প্রথম কিছু বলার জো থাকে না। তাই সেদিনের মতো একরকম নিরুত্তর থেকেই গেল।বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর দিদা ওকে জিজ্ঞেস করল,তোর খাওয়া হয়ে গেছে? একটা অপরিসীম বোধ নিয়েই উত্তর দিল,হু হু কক্ষন। এই বেরোব এখন কলেজ যাব।

এই প্রথম চেতনার মধ্যে দিয়ে একটা স্বাভাবিক বোধ নাড়া দিল ওর অস্থি মজ্জায়। যা কিছু কঠিন তাকে সরল করে দেখার প্রবণতা। আর যাকিছু সরল তাকে নিজের মনের মতো করে রূপ দেওয়া। এই সেই বিরাট শহরে চলে আসা ছেলেটার একটা বিরাট উপলব্ধি, এক সরল সত্য, যা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করল। এই চেতনা অনেকটা জীবন বোধের।যে সরলতা নিয়ে এতদিন একটা প্রবাহে ভেসে ভেসে এই পারে এসে ঠেকল, আজ যেন জীবনের সেই পুরোনো ফেলে আসা অতীত ওকে অনকেটা সঙ্গ দিল।

কাউকেই কিছু না জানিয়ে কলেজের জন্য বেরিয়ে গেল।প্রথমে ওকে হেঁটেই লঞ্চের পারে আসতে হতো। এখানে আসার অঙ্গে সঙ্গে ওর কোন সাইকেল ছিল না। তাই প্রায় দেড়'কিমি হেঁটেই তাকে যেতে হতো লঞ্চ ঘাটে। সেখানে কত পথঘাট ছিল তার অজানা।কত গলিপথ ছিল নিঃসঙ্গতার একমাত্র চাবিকাঠি।এই শহরের পথ ধরেই নিত্য দিনের ওর চলাফেরা। সেদিন অনেক ধরনের চিন্তা মাথায় নিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে থাকল। বইয়ের ভারে জোরে হাঁটার জন্য গায়ে ঘাম জমতে লাগল। সময়ে সে ঘাম গা দিয়ে চুঁয়ে চুঁয়ে ওর জামাটা ভিজিয়ে দিল। প্রথমবারের জন্য কোন বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকার অভিজ্ঞতা ওকে আরও কেমন যেন ইশারা করতে থাকল। সেদিন ওর আর খাওয়াই হলো না। গঙ্গা পার করে স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে উঠে শিয়ালদা স্টেশন। তারপর একটু হেঁটেই কলেজে ঢুকল।ঢুকেই দেখা হল সঞ্জয় আর অভিষেকের সঙ্গে। দুজনেই বলল,কী হল ভাই। এতো দেরি। একটা মনমড়া ইঙ্গিত দিল দুজনকেই। তারপর উঠে যাচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে। ওরা ততক্ষণ নিচেই নেমেছে খেতে,বলল,ওদিকে কোথায়। চল পার্কে একটু খেয়ে আসি।আজ খাওয়া হয়নি। এই কথাটা শোনা মাত্রই একটু প্রাণ ফিরে পেল যেন। মুহূর্তের মধ্যে একটা অন্য মুখ নিয়ে বলল,দাঁড়া যাব আমারও খাওয়া হয়নি। ব্যাগটা রেখে আসি। ব্যাগ রেখে এসে তিনজনেই কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দুপুরের রোদ তখন জ্বল জ্বল করছে। এই প্রথম এই শহরের কোন প্রিয় মানুষের সঙ্গে ওর আরও অনেকটা সম্পর্ক বাঁধল।

Comments

Anonymous said…
বেশ লাগল এই ভাগটাও।

আরও পড়ুন

সৌমাল্য গরাই

কবিতা সিরিজ

কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৪

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৮

একটি কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ২

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৬