“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৬
সেদিন বিকেলে এগলি সেগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছল কলেজ স্ট্রিট। ছোটবেলা থেকেই নীলাদ্রি এই কলেজ স্ট্রিট সম্পর্কে জেনে এসেছে। কারণ ছোটবেলাতে ওর মামার বাড়ি এই অঞ্চলেই ছিল। তাই যতবার নিজের বাড়ি থেকে মামার বাড়িতে বেড়াতে আসতো তখন মাঝে মাঝেই এই কলেজ স্ট্রিট চত্বরে বেড়াতে আসতো বাবার হাত ধরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ স্কোয়ার, কফি হাউজ, বসন্ত কেবিন এই সবগুলোই কেমন যেন চোখের সামনে পুরনো সেই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট এর মত ভেসে উঠলো। আসার সময় দুই বন্ধুকেই বলেছে আজকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাব। তাই একটু আগেই বেরিয়ে যাব।
কিন্তু তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরে সোজা চলে এলো এই কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়। সেই পুরনো বইয়ের দোকান, শত শত মানুষের আনাগোনা। বইপত্র ঘাটাঘাঁটি। বইপত্র কিছু কেনাকাটি, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত পড়ুয়া থেকে কত শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্রফেসরদের চলে এই বইপাড়ায় আনাগোনা। একটা চায়ের দোকানে নীলাদ্রি বসলো। এরপর ভাবনা চিন্তা করতে লাগলো যদি তাকে এই কলেজের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তাহলে নিজেকে কিছুটা উপার্জন করতে হবে। কেননা বাড়ি থেকে কিন্তু টাকা আসার অনিশ্চয়তা একটা তৈরি হচ্ছে। সেটা হয়তো আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই হয়ে যেতে পারে। এই চিন্তা ভাবনা করতে করতেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো কীভাবে উপার্জন করবে? এই বড় শহরে উপার্জন করার অনেক কাজ রয়েছে, কিন্তু কোন কাজটা সে করতে পারবে? যা থেকে প্রয়োজনমতো মাসোহারা তার চলে যেতে পারে। এদিকে কলেজে দুই বন্ধু সাথে কথাবার্তা বলল লাইব্রেরীতে ফর্ম তুলতে হবে এবং মেম্বারশিপ নিতে হবে। তাতেও তো বেশ কিছু টাকা দরকার। মফস্বলে থাকাকালীন সেভাবে কোন লাইব্রেরীর সদস্য সে কোনদিনই ছিল না। ফলে বৃহত্তর শহরের বুকে যে লাইব্রেরীতে সে ভাবল মেম্বারশিপ নেবে সেই লাইব্রেরীর নিয়ম-কানুন সমস্ত কিছুই জানার চেষ্টা করতে লাগলো। পরের দিন ওদের কথা দিয়েছে সন্ধ্যেবেলার দিকে কলেজ শেষ করে ওরা তিনজনের লাইব্রেরীতে যাবে। ওদের ওখানে সারা বছরের একটা মেম্বারশিপ নিতে হবে সম্ভবত কি বাবদ প্রায় শদেড়েক টাকা। এই টাকাটাও ওকে এই কদিনের মধ্যে যোগাড় করতে হবে। চায়ের দোকানে বসে চাই চুমুক দিতে দিতে এই সমস্ত কিছু তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক করতে লাগলো। কেমন যেন একটা দুশ্চিন্তা তার মনকে নাড়া দিল। এক কাপ চা খাবার পর আরো এক কাপ চা নিলো। আবার নিরন্তর ভাবতেই থাকলো কিভাবে আগামীকালকের সেই টাকাটা যোগাড় করা যায়। মনে মনে এভাবে ভাবতে লাগলো তাহলে আগামীকাল যদি টাকা পয়সার বিষয়টা বুঝে নিতে পারি, তাহলে নয় আরো সাত দিন সময় নেওয়া যাবে লাইব্রেরী মেম্বারশিপ এর জন্য। আর ইতিমধ্যে যদি দুই বন্ধু ওরা আগে মেম্বারশিপ নিয়ে নেয় তাহলে নয় নিয়ে নিক সে পড়ে নেবে। কারণ এই মুহূর্তে পরা চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ওই টাকাটা কোনোভাবেই জোগাড় করা সম্ভব নয়। এ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চায়ের কাপ ফেলে ভাবল যদি দিদাকে টাকাটা চায়? আশা করি দিদা না দেওয়া করবে না। অকস্মাৎ দিদার এই ভাবনাটাই কিছুটা যেন প্রখর তপ্ত ফুটি ফাটা মাঠে এক পশলা বর্ষার বৃষ্টির মতো পরিকল্পনা সিক্ত হল। আচমকাই একটু আশ্বস্ত হলো এই ভেবে যাক আপাতত সে রকম হলে দিদার থেকেই নয় মেম্বারশিপের টাকাটা নিয়ে কোনরকমে ম্যানেজ করে নেবে।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনস্থির করল, সে দিদাকে বলেই টাকাটা নেবে। এরপর সোজা কলেজ স্ট্রিট থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো শিয়ালদা স্টেশন। প্রতিদিনের মতো বিকেল চারটের ট্রেন টা না ধরে সাড়ে চারটের ট্রেনটা ধরল। ট্রেন এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এলো। তারপর সময়ের থেকে প্রায় দশ মিনিট লেটে ছাড়ল। ঘন্টা খানেক পর নৈহাটি নামল। তারপর স্টেশন থেকে হেঁটে লঞ্চ ঘাট। সেখান থেকে আবার সোজা হেঁটে বাড়ি।
আত্ম উপলদ্ধি আর আত্ম অনুশোচনা নীলাদ্রির বিশেষ গুণ। কোনো কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ ভাবলে বা করলে ও একটু বিষন্ন থাকত। তাই নৈহাটি স্টেশনে নেমেই সন্ধ্যের খাবার হিসেবে প্রতিদিন ও একটা কোয়াটার পাউরুটি, দুটো দানাদার মিষ্টি আর ছ টাকায় পাঁচটা সিঙ্গাপুরী কলা কিনে নিয়ে যেত। সেদিন এসব কিছু কিনল না। কোথাও যেন ওর মন খট খট করতে লাগল। দিদাকে কি ও বলবে? দিদাকে বলাটা কি ভালো হবে? দিদা কী ভাববে? কোনোদিন ও কিছু চায়নি। কিন্তু আজ চাওয়াটা কি ঠিক হবে? তাই এই একটা অদ্ভুত চিন্তা করতে করতে নিজের খাবারটা না নিয়েই লঞ্চ ঘাটের দিকে চলে গেছিল। এপারে নেমে যখন হেঁটে বাড়ি যাচ্ছিল, তখন প্রায় সন্ধ্যে। সূর্যের সামান্য আলো ঠিকরে আকাশ কিছুটা লাল হয়ে আছে। গাছের ওপরে বসে থাকা বাদুড়ের দল সব ডাল পালা দখল করেছে। নীলাদ্রি সোজা হেঁটে যাচ্ছে। সঙ্গে হাঁটছে ওর দুশ্চিন্তা। বাড়ির চৌকাটে যখন এসে পৌঁছল তখন দেখল দিদা বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে। দেখে বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে? দিদা বলল, মাইমা নেই। সন্ধ্যে হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে গেছে। বাড়িতে এখনও সন্ধ্যে পরেনি। বললাম, কেন মামা? দিদা বলল, ঘুমোচ্ছে। শুনে ও জামাপ্যান্ট ছাড়ল। দিদা ততক্ষণে দরজা ছেড়ে এসে বাড়ির ছোট্ট উঠোনের একটা সিঁড়িতে বসে বিড় বিড় করতে লাগল। জামাল্যান্ট দড়িতে শুকোতে দিয়ে বলল, কিছু বলছ দিদা? দিদা বলল, একটু তাহলে ওপরে গিয়ে সন্ধ্যে দিয়ে দিতে পারবি? শুনে বলল, হ্যা হ্যা কেন পারব না। বলেই গামছা কোমরে জড়িয়ে দোতলায় ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যে দিয়ে দিল। ধুপ জ্বালিয়ে আর শঙ্খ বাজিয়ে। দিদা বলল, অপরের ঠাকুর ঘরে ধুপ আর নিচের তুলসি তলায় ধুপ দিয়ে দিস। সেই মতো ওপরে ধুপ দিল। আর একটা ধুপ নিচে নিয়ে এলো। নিচে এসেই দিদা বলল, শঙ্খ কি মামা বাজিয়ে দিলে? শুনে ও বলল, না - ওই বাজিয়েছে। দিদার কোনো ধারণায় ছিল না, একটা মফস্বলের ছেলে ভর সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজিয়ে সন্ধ্যাদীপ দিয়ে দিতে পারবে। বলল, তুই তো ভালো শঙ্খ বাজাস। ওরাতো এতো ভালো করে বাজাতে পারে না। নিচে থাকলে ওপর থেকে শোনা যায় না।
নিজের প্রশংসা শোনা মানবজাতির মারাত্মক আত্মবিশ্বাসের। তাই নীলাদ্রি এর থেকে আর কম কি। আর হঠাৎই মাথায় একটা আইডিয়া এলো। আচ্ছা এখনই যদি দিদাকে টাকাটার কথা বলা যায়! এখন দিদাও একটু হালকা মুডে আছে। ভাবতে ভাবতেই দিদাকে বলল, চা খাবে? করব? চা প্রিয় দিদা কি আর ছাড়ে, বলল কর। কিন্তু তখনই দিদার মনে পড়ল চায়ের দুধ নেই। নীলাদ্রিকে বলল, তাহলে পয়সা দিচ্ছি একটু দুধ নিয়ে আয় আর দুটো ফুলুরি নিয়ে চলে আয়। বলে দিদা ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে, একটা স্টিলের কৌটো থেকে টাকা বার করে দিল। এইবার বলার সময়। জামা প্যান্ট পরে ও দিদার ঘরে এলো। হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, একটা দুধ আর একটু চিনি, আর ওদিকে মিষ্টি নিয়ে নিসতো। তখন ও ভাবছে দিদাকে বলবে কিনা! বা দিদাকে বলাটা ঠিক হবে কিনা! একটু কপালে ঘাম জমে আসছে। দিদা খাটে বসে। জিনিসগুলো আনার কথা শেষ করতেই প্রচণ্ড সাহস আর এক ধরনের বলা যেতে পারে দুঃসাহসিকতা নিয়েই বলল, দিদা একটা কথা বলব? কলেজে কিছু বইপত্রের জন্য সামনে সপ্তাহে লাইব্রেরীতে যেতে হবে। ওখানে মেম্বার ফিজ নেবে। তুমি একটু দিতে পারবে। মা রা এলে তোমাকে দিয়ে দেব। শুনেই দিদা বলল, কত টাকা। ও বলল ওই একশো কুড়ি টাকার মতো। শুনে বলল, আচ্ছা নিও। ব্যাস। ভয়ংকর একটা ঝড় শেষে শান্ত হাওয়া যেভাবে চারিদিক ঠাণ্ডা করে দেয়। নীলাদ্রির এই ঘটনা যেন ওকে অনেক স্বস্তি দিল। বাইরে বেরিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা আশ্বাস দিয়ে গলি দিয়ে বড় রাস্তায় এলো। সন্ধ্যের রাস্তাঘাটে তখন জন সমাগম। মিষ্টির দোকানে মিষ্টি আর দুধ নিয়ে গেল একটা ঘুমটির দোকানে। ওখানে নিরামিষ চপ পাওয়া যায়। দোকানদারকে বলল, দুটো ফুলুরি দিনতো।
Comments