“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৭

 




কোনো রকমে নীলাদ্রির লাইব্রেরির টাকাটা জোগাড় হলো। এবার আর যাইহোক কিছুটা স্বস্তি। কলেজের পর এবার লাইব্রেরিতে কিছুটা কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে পারবে। একটা যেন ম্যাচ জিতে গেল। টান টান সে খেলা। শেষমেষ জিততে পারবে কিনা, এই সংশয় আর দ্বন্দ্ব ছিল। এভাবে কোনোদিন টাকার জন্য এতোটা লড়াই করতে হয়নি। এই ছোট্ট ঘটনা যেন ওকে জীবনের অনেকটা পথ চিনিয়ে দিল।

পরের দিন কলেজে আবার তিন বন্ধু এক জাগায় হয়েছে। কথা বার্তা চলছে, যে সন্ধ্যায় যাবে লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ নিতে। ওইদিন কলেজে বাংলা বিভাগের একজন প্রফেসর উপন্যাস পড়াতে এলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর চোখের বালি। নীলাদ্রির প্রথম উপন্যাস পড়া। তাও আবার চোখের বালি। কতটুকুই বা জ্ঞান, অভিজ্ঞতা রয়েছে যে চোখের বালি পড়ে ফেলতে পারবে! ক্লাসে ওর প্রফেসর জিজ্ঞেস করল, কী বই পড়তে ভালো লাগে? 

- ম্যাম মোটামুটি সব। 

- গান শোনা হয়?

- হ্যা। 

- কোন লেখক প্রিয়?

- একটু আমতা আমতা করে বলল, ম্যাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

- কী কী পড়েছ?

ব্যাস এবার আর তেমন কোনো উত্তর নেই। আসলে নীলাদ্রি কোনদিনও বাংলা সেভাবে পড়েনি। ওই বাবার কাছে বার বার শুনতো রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র। সামান্য জানা দিয়ে আগ্রহ বাড়ানো যেতে পারে। চর্চা বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু নিজস্ব তাগিদ ভালোবাসা নেশা না থাকলে, কোনকিছুই হয় না। মুহূর্তের মধ্যেই মাথায় এই সমস্ত কিছু ঘুরপাক খেতে থাকল। ম্যাম বললেন - এই যে কী কী পড়েছ?

- ম্যাম তেমন কিছু পড়া নেই।

- ও, কিন্তু অনেক পড়তে হবে। যা যা জানার সবই জানতে হবে। তাছাড়া রাস্তা নেই। 

এক অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে। কলকাতা যার কাছে স্বপ্ন। যে পাড়াগাঁয়ে মানুষ হয়েছে। সেই ভিটে মাটির তল ছেড়ে আকাশে প্রায় দশ কিলোমিটার ওপর দিয়ে প্লেন যায়। সকালে বা রাতে যখনই প্লেন দেখতো, তখন কত ছোট দেখত। কেমন ছোট্ট পিঁপড়ের মতো নীল আকাশের গায়ে সাদা ধোঁয়ার দাগ কাটতে কাটতে চলে যেতো কখন পূর্ব থেকে পশ্চিম, নয়তো পশ্চিম থেকে পূর্বে। আর রাতের অন্ধকারে যখন কালো আকাশের বুকে দেখতো, তখন মনে হতো যেন, কোনো তারায় জ্বল জ্বল করে চলে যাচ্ছে। আজ এতো বছর পর এই মহানগরের বুকে এসেছে। এখানকার কলেজে ভর্তি হয়েছে। সেই প্লেন এখানে মাটি ছুঁয়ে উড়ে যায়। বিরাট একটা স্বপ্ন। সবটা যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। পেটটা কেমন করছে। নানা চিন্তা মাথায় ঢুকছে। কী জবাব দেবে। 

- আবার, আমতা আমতা করে বলল, ম্যাম আমরা লাইব্রেরীতে মেম্বারশিপ নিয়েছি। শুনেই ম্যাম বললেন - বাঃ, এতো দারুণ ব্যাপার। হ্যা পড়াশোনার জন্য, কাজের জন্য তোমাকে লাইব্রেরী রিসার্চ করতেই হবে। পাশ থেকে সঞ্জয় বলল, - ম্যাম, ওখানেই অনেকটা কাজ করতে হবে। 

বিকেলে মোটামুটি একটু তাড়াতাড়ি করেই বেরোল। নীলাদ্রির পকেটে আছে মাত্র একশো আঠাশ টাকা। গতকাল দিদার থেকে একশো কুড়ি টাকা পেয়েছে। আর দশ টাকা পেয়েছে, একটা নতুন চালাকি করে। গতকালকের কিছু দোকান বাজার করে যেটাকা ফেরত এসেছিল, তার থেকেই একেবারে ডেসপ্যারেট ভাবেই দশ টাকা কম দিয়ে একটা হিসেব দেখিয়ে দিয়েছিল। তাই সকালে তার থেকে দুটাকা লঞ্চে দিয়েছে। আর এখন কলেজ থেকে আবার যাবে বিবেকানন্দ রোডে। রামমোহন লাইব্রেরীতে। কিন্তু এতটা রাস্তা যাবে কি করে। অন্যথায় হেঁটে যাবে বলেই মনস্থির করল। ইতিমধ্যেই টিফিন টাইমে ইংরেজি সেকশন থেকে অভিষেক এলো। বলল, কি রে ভাই। আজ যাবি তো। নীলাদ্রির একটু মন কেমন দুর পুক করতে লাহ কেননা, যাবে কিন্তু বাস ভাড়া আর হবে না। একটু দোনামোনা করতে করতে বলল, হ্যা রে বাসে যাবি? কথা শুনেই অভিষেক বলল, দূর। পাগল নাকি। এই টুকু রাস্তা যাব বাসে। হেঁটে চলে যাব। দুটো বিড়ি খেতে খেতে পৌঁছে যাব। আবার সেই নীলাদ্রির মতোই সব কিছু যেন।।এইতো চেয়েছিল ও। এইভাবেই তো মহানগরের কোলে কান পেতে শুনেছিল আহ্বান। যাক আর চিন্তা নেই। ওপর থেকে নিচে নেমে এলো। কলেজের গেটের সামনেই একটা চায়ের দোকান মিঠু দির। ওখানে চা খেল। টাকা অভিষেক দিল। তারপর আবার কলেজ স্ট্রিট। একটা কি বই কেনার আছে অভিষেকের। তাই বলল, আগে কলেজ স্ট্রিট হয়ে তারপর সোজা হাঁটা। সেদিনের সেই ব্যস্ত কলেজ পাড়া। কত মানুষের আনাগোনা। কত ছোট বড় দোকান। কত মানুষের রুটি রোজগার। 

বই পাড়ায় এসে, সঞ্জয় বলল কফি হাউস দেখেছিস? বলল, না তো। শুনেছি। কোথায় ? সঞ্জয় বলল, চল একবার ঢু দিয়ে চলে যাব। শুনে নীলাদ্রি বলল, ওখানে ঢুকতে পয়সা লাগে না? সঞ্জয় বলল, দূর পাগল। ওটা ওপেন। সবার জন্য। এই ওপেন শব্দটার মানে নীলাদ্রি কিন্তু প্রথমে বুঝেছিল খোলা আকাশের নিচে। কিন্ত যখন দুজনের সঙ্গে গেল। তখন ওর ধারণাটায় কেমন যেন পাল্টে গেল। আরে এটা তো অন্য ধরনের। সিঁড়ি দিয়ে বেয়ে ওপরে উঠল। দেখল বড় একটা চাতাল। সাদা পোশাকি ড্রেস পরে টেবিলে সব নানা ধরনের, চা সার্ভ করছে। এই প্রথম ওর কফি হাউস দেখা। কত লেখক কবি, গায়ক গায়িকা, শিল্পী অভিনেতা এই কফি হাউসে আসেন বলে বাড়ির টিভিতে দেখেছে। আজ এই কফি হাউসের টেবিল দেখে সেই সব ছবি মনেপড়ল। মুহূর্তের মধ্যে একটা আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ওর মন যেন ভরে গেল তৃপ্তিতে। কী অসাধারণ প্রাপ্তি। সেই সময়ে আজকের মতো কলেজ পড়ুয়াদের হাতেও এতো স্মার্ট ফোন ছিল যে, চট করেই একটা দুটো ছবি স্মৃতি হিসেবে তুলে নিতে পারবে। তাই চোখের দেখায় যেন শেষ দেখা। চোখের দেখায় যেন শ্রেষ্ঠ। কিছুক্ষণ ওখানে থেকে বেরিয়ে পড়ল। এবার গন্তব্য বিবেকানন্দ রোড। 

সোজা কলেজ স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে বিধান সরণী রোড ধরে সোজা হাঁটা। কলেজ স্ট্রিট বাটা, ঠনঠনে কালী বাড়ি, বিদ্যাসাগর কলেজ। আরে এতো সব ওই সব দিনের রাস্তা বাবার হাত ধরে আসতো। কতবার কলকাতার মামার বাড়ি এলে মাইমার সঙ্গে আসতো সন্ধ্যের দিকে এই ঠনঠনিয়া কালী বাড়িতে। একের পর এক কত স্মৃতি কুড়োতে কুড়োতে হেঁটে যাচ্ছে। তারপর এলো বিদ্যাসাগর কলেজ। প্রথম মায়ের সঙ্গে যেদিন কলকাতার কলেজে ফর্ম তুলতে এলো, সেদিনও এই কলেজেই ফর্ম তুলে ছিল। কিন্তু না না ,এটা তো নয়। বিদ্যাসাগর কলেজ একটা গলি দিয়ে ঢুকে বাম হাতে পড়েছিল। অভিষেক সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করল, এইটা আর কোনো আছে ? এটাতে তো আমি ফর্ম তুলতে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা তো রাস্তার ওপরে ছিল না। গলির ভেতর ছিল। অভিষেক বলল, হ্যা ঠিকই বলেছিস। এটা মর্নিং। আর ওটা আছে। একটু হাঁট। পরের গলিতেই। এবার সেই গলির মুখেই আসতেই দেখল, হ্যা ওই যে। বাম হাতে। তারপর এলো বিবেকানন্দ মোড়। এবার ডান দিকে বেঁকে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বিবেকানন্দ রোডের সেই রামমোহন লাইব্রেরী। কত স্বপ্ন ঘিয়ে আসছে ওর চিন্তায়, ভাবনায়। যদিও এই লাইব্রেরীর একটা মেম্বারশিপ হউওটা কোনো ব্যাপারই নয় কলকাতার পড়ুয়াদের কাছে। কিন্তু মফঃস্বল থেকে আসা নীলাদ্রির কাছে, এটাই অনেকটা ইতিহাস স্বাক্ষ্য রাখে। এরপর লাইব্রেরীর অফিসে গিয়ে ফর্ম নিয়ে, ফর্ম জমা করল। পকেটে একশো আঠাশ টাকা থেকে একশো কুড়ি টাকা দিয়ে ফর্ম জমা করল। অনেকটা শান্তি, নিশ্চিত হলো যেন। লাইব্রেরীর ব্যবহারের কিছু নিয়ম কানুন আছে। সেগুলো বলে দেওয়া হলো। বাকিটা আসতে আসতে, শিখে যাবে। এটাই তো অনেকটা প্রাপ্তি। কত বই। কত প্রয়োজনীয় কাজ। কী কী করবে, এই নিয়ে বিরাট একটা উন্মাদনা নিয়েই একথা সেকথা ভাবতে লাগল। 

সবকিছুর শেষে সূর্য ডুবে এলো। অনেকটা রাত হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরতে হবে। সেদিন জানত না। বাড়ি ফিরে আরও একটা ঘটনা ওর জন্য অপেক্ষায়। এখন যদি বাসে করে যায় তাহলে, আবার বাস ভাড়া লাগবে। সঞ্জয় বলল, তুই বাসেই চলে যা। শুনে একটু ইতস্তত হয়ে বলল, ভাড়ার টাকা নেই। শুনেই সঞ্জয় অভিষেক বলল, ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এতোটা রাস্তা তোকে যেতে হবে। পকেটে মাত্র আট টাকা। সেই টাকায় ফিরতে হবে বাড়ি। মুহূর্তের মধ্যেই সঞ্জয় পকেটে দশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলল, বাস ধরে নে। শিয়ালদা চলে যা। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। নীলাদ্রি দেখল, এটাই ঠিক হবে। বাস ধরে শিয়ালদা। তারপর ট্রেন ধরে সোজা বাড়ি। বাস, ট্রেন, লঞ্চ এসব কিছু করে ফেরত যখন বাড়ি ঢুকল রাত প্রায় ন ' টা। তখন দোতলায় বড়মামা ছিল। এসে দেখল বাড়ির সদর দরজা খোলা। কিন্তু ভেতরের গ্রিলে তালা পরে গেছে। দুয়েকবার ডাক দিতেই দিদা এসে খুলল গ্রিল। বড়মামা ওপর থেকে খুব চ্যাঁচামেচি করছে। কলেজ কটায় ছুটি হয়? রাত ন টা বেজে গেল। গ্রিলে তালা পরে যাবে। এতো রাত করে ফেরা যাবে না। ঢুকেই ওপরের চ্যাঁচামেচি শুনতে পেল। একটু হতভম্ব হয়ে গেল। কীসের জন্য? ও রাত করে বাড়ি ফিরেছে তারজন্য? নাকি অন্য কিছু। ঢুকে জুতো খুলতেই বড় মামা নিচে এস বলল, এতো রাত করে তো ফেরা চলবে না। এখানে তো কিছু নিয়মকানুন আছে। কলেজ কটায় ছুটি হয়? কোনরকমে নিজের আজকের লেট হয়ে ফেরার কথা বলল। শুনে বলল, লাইব্রেরীতো এখানেও আছে। এখানে হলেই হবে। বলে ওপরে উঠে চলে গেল।

এক অজানা আশঙ্কা এই প্রথম নীলাদ্রি আঁচ করল। রাতে তেমন কিছু খেল না। ছোট্ট ফোন অভিষেক আর সঞ্জয়কে একটা এস এম এস করে দিল। ঘরে ঢুকে গেল। অনেকটা রাত ঘরের চেয়ারে বসে কাটল। একটা সময় অভিষেককে একটা এস এম এস করে শুয়ে পড়ল। যাতে লেখা ছিল, কাল তোর সাথে একটু কথা আছে। ঘরের আলো নিভে গেল আর ঘড় ঘড় শব্দে ফ্যান আওয়াজ রাত আরও গভীর করে দিল। 




Comments

আরও পড়ুন

সৌমাল্য গরাই

কবিতা সিরিজ

কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৪

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৮

একটি কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ২

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৬