“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৮
পরের দিন খুব সকালেই নীলাদ্রি ঘুম থেকে উঠে পড়ল। মাথার মধ্যে তখন একটাই চিন্তা আর দুশ্চিন্তা পাক খাচ্ছে থেকে থেকে। যদি পড়াশোনাকে ঠিকভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে হয় তাহলে তো পড়াশোনার পাশাপাশি নানান ধরনের যোগাযোগ ও পড়াশোনা কেন্দ্রিক চর্চা তাকে চালিয়ে যেতেই হবে। আর তার জন্য শুধুমাত্র এই শহর থেকে কলকাতা যাতায়াত করে সম্ভব হয়ে উঠবে না। স্বপ্ন দেখা ভালো, কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে জীবনের প্রতিটি সময় থেকে মুহূর্তকে যেভাবে একটু একটু করে তৈরি করতে হয়, আজকের সকাল হওয়া দিন থেকে যেন ঠিক সেই রকমই তৈরির প্রথম পদক্ষেপ সুনিশ্চিত হল নীলাদির জীবনে। কিন্তু এই তৈরি করার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষ, সমাজ এবং সময় সবইতো তার হাতের বাইরে। কাকে নিয়ে এগিয়ে যাবে, আর কাকে না নিয়ে ফেলে রেখে যাবে তার শৈশবের স্মৃতি থেকে আজকের সময়। এই ধরনের নানা ভাবনা-চিন্তা মাথার মধ্যে উদ্ভট হয়ে সবকিছুকে যেন আচমকায় ভুলিয়ে দিল। সামান্য লাইব্রেরির কাজ করে ফিরে এসে বড় মামার কাছে তাকে যে কটু কথা শুনতে হয়েছে, সে কথাই যেন তাকে বারবার বিদ্ধ করছে। কিন্তু উপায়ও যে খুব একটা বেশি রয়েছে এমনটা নয়। বাড়ির আর্থিক অসংগতির একটা আভাস কোথাও যেন তার কাছে আসছে। এইতো সামান্য এটা থেকে ওটা যেখানে মহানগরের মতো শহরে বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিমুহূর্তেই অর্থের দরকার, সেখানে যেন তেনো প্রকারের চালিয়ে নেওয়াটাতো বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু কি করেই বা এই অসংগতি থেকে কিছুটা সঙ্গতির রক্ষা করবে এইটাই হয়ে গেল তার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এইসব ভাবতে ভাবতেই সকালে উঠে চা করে নিজে চা খেলো। এরপর দিদাকে এক কাপ চা করে দিলো। তারপর স্নান সেরে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। আজকে অবশ্য সে খেয়ে বেরোতে পারেনি, তাই দিদাকে বলল আজকে বাইরে খেয়ে নেবে। এই বলে বেরিয়ে গেল। ট্রেনে যেতে যেতে ভাবতে লাগলো যদি কলকাতাতে একটা স্থায়ী ভাবে বসবাসের কোন ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু কলকাতা মতো শহরে বসবাস করাতো মুখের কথা নয়। এই মহানগরের বুকে অন্তত বেঁচে থাকতে গেলে মাসিক খরচের একটা ন্যূনতম যোগান যদি না থাকে তাহলে মহাবিপদ। আর এই কয়েক মাসে তাকে কেইবা চিনবে কেইবা জানবে যে তার জন্য কিছু করতে পারে। যে মফস্বল শহরের নিজের ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে সেখানে দেখেছে মানুষের সাথে মানুষের কত সংযোগ, দিনের পর দিন এই মানুষের বাড়ি ওমানুষের বাড়িতে অনায়াসেই থাকতে পারে। এক বাড়ির লোক অন্য বাড়ির লোককে ডেকে ডেকে খাওয়ায়, সকালে খাওয়ায় , দুপুরে খাওয়ায় আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ির বিরাট অবস্থাপন্ন থাকলে কত ছেলেপুলে থেকে মানুষজনকে বছরের পর বছর আশ্রয় দেয়। কিন্তু এই শহর সেই মানসিকতা নিয়ে কি আজও চলাফেরা করে? এই শহর তার অলিন্দে কি আদর্শ এই মনুষ্যত্বের চিন্তা ঘুরে বেড়ায়? - এই সমস্ত প্রশ্নই তাকে আরো বিচলিত করে দিল। কিন্তু পথ তো একটা বার করতে হবেই। আর যাই হোক কলেজে ভর্তি হয়ে যে বন্ধুদের সঙ্গে সঙ্গ পেয়েছে অন্তত তাদের সাথে যদি কিছু যুক্তি পরামর্শ করা যায় অন্তত তাতেও যদি কোন সমাধান আসে। তাই মনে মনে স্থির করল অভিষেক অথবা সঞ্জয়কে এই কথাটা বলবে। তাছাড়া এই কদিনে সে নিজেও দেখেছে কত দূর দূরান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা আসে কলেজে পড়াশোনা করে, নানান রকম মেয়ের থেকে বোর্ডিং সর্বত্রই কত সস্তায় কোন রকমে পড়াশোনার জন্য ছেলেমেয়েরা থেকে যায় বছরের পর বছর। সমস্যা একটাই যে সমস্ত ছেলে মেয়েরা এখানে থাকে তাদের সবারই আর্থিক ব্যবস্থার সার্বিক দিকটাই বাড়ি থেকে চালিত হয়। কিন্তু নীলাদ্রিরতো সে অবস্থায়ও মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে ক্ষীন হয়ে আসছে। তাই বাইরে থেকে অন্য জনের জীবনযাত্রা থেকে বেঁচে থাকা দেখতে সবই ভালো লাগে, তার পেছনের নেপথ্যের ইতিহাস জানতে গেলে মন সবসময় ভারাক্রান্ত হয়। একরাশ চিন্তা কালো মেঘের মতো মাথার ওপরে জমা হয়। সময়ে সময়ে ঘনীভূত হয়ে চিন্তা যেন মাথাকে ভার করে তোলে। ইতিমধ্যেই ট্রেন তখন কারশেড ছাড়িয়ে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে ঢুকছে। সবকিছু মাথা থেকে মুহূর্তের মধ্যেই সরিয়ে দিল। মনে মনে ভাবলো দেখি আজ একবার সঞ্জয় অথবা অভিষেককে কথাটা বলি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবতে লাগলো কীভাবে শুরু করবে? নাকি আবার কোন অন্য একটা কাহিনি বানাতে হবে? এইসব ভাবতে ভাবতেই শিয়ালদা স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে ট্রেন এসে দাঁড়ালো। নীলাদ্রি নামলো। মিনিট কুড়ি হেঁটে কলেজে ঢুকলো। ততক্ষণে কলেজের ক্লাস শুরু হয়েছে।
আজকের ক্লাসের বিষয়বস্তু হলো কথাসাহিত্য। তাই কথাসাহিত্য বিষয়ক আলোচনা থেকে উপন্যাস সবই আলোচনা পর্যালোচনা হবে আজকের ক্লাসে। এবং সেজন্যই প্রফেসর তাদের একটা উপন্যাস পড়ে আসতে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি। এক অজ পাড়া গাঁয়ে থাকা, শান্ত মিতভাষী একটি ছেলে সে পড়ে ফেলতে পেরেছে চোখের বালি মতো উপন্যাস। এই উপন্যাস পড়াটাই তার কাছে একটা বিরাট প্রাপ্তি এবং অনভিপ্রেত ঘটনা। কারণ যে ছেলেটি আজকে বাংলা অনার্স পড়তে এসে চোখের বালি উপন্যাসটা পড়ে ফেলেছে, এবং এই ছেলেটি কিন্তু কোন রকম ভাবেই তার আগের কোনো পড়াশোনায় বাংলাকে সেভাবে কোনদিন পড়েনি। যদিও এই পড়ে না আসার কারণ তার বাংলার প্রতি বা বাংলা সাহিত্যের প্রতি বিরাট একটা প্রীতি বা সম্পর্ক অথবা ভালোবাসা যে ছিল তেমন নয়। ফলে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তার পড়াশোনার সার্বিক একটা পরিবর্তন ঘটতে থাকলো। যে ছেলেটি নিজে কোনদিন গল্পের পর গল্প পাতার পর পাতা পড়ে উঠতে পারেনি। যে ছেলেটি তার কাছে গল্প উপন্যাস কবিতা সেভাবে কোনদিনই মনকে নাড়া দেয়নি। সেই ছেলেই আজ একটি উপন্যাস পড়ে ফেলেছে এবং এই উপন্যাস নিয়েই আজকের ক্লাসের আলোচনা থেকে সমালোচনা এসব টুকুই সাক্ষী থাকতে হবে। এর মধ্যে এমনও হতে পারে উপন্যাসের নানান রকম বিষয় বস্তু থেকে আঙ্গিক ও সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে তাকে হয়তো প্রফেসর প্রয়োজন মনে করলে দু চারটে প্রশ্ন করতে পারে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আজকের ক্লাস তার কাছে একটা বিশেষ দিন। তাই ক্লাসে যখন প্রফেসর ঢুকলেন এবং কথাসাহিত্য পড়াতে পড়াতে যখন তিনি নানান ধরনের আলোচনা ও প্রসঙ্গ তুলে আনছেন তখনই নীলাদ্রিকে প্রশ্ন করা হলো --
- তুমি চোখের বালি উপন্যাস পড়েছো?
- হ্যাঁ ম্যাম পড়েছি।
- উপন্যাসটা যখন পড়েছো তাহলে যদি তোমাকে দু-চারটে প্রশ্ন করি আশা করি বলতে পারবে?
- শুনেই বলল হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই পারবো।
- আচ্ছা একটা প্রশ্ন বলতো সারা চোখের বালি উপন্যাসে চোখের বালি কে?
- এই প্রশ্ন তার কাছে কেমন যেন একটা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো? সত্যিই তো এই প্রশ্ন তো কখনো তার মাথার মধ্যে আসেনি! কালজয়ী এরকম একটি উপন্যাস সারা রাত জেগে যখন পড়ে ফেলেছে, তখন এই উপন্যাসের বিষয়কে কেন্দ্র করে ঠিক চোখের বালি অর্থাৎ চোখের শত্রু অথবা চক্ষুশূল -- তাহলে কে? (প্রফেসরের প্রশ্ন শোনা মাত্রই মুহূর্তের মধ্যেই তার মাথার মধ্যে এই সমস্ত জিনিস ঘুরতে লাগলো)। উত্তর দিল উপন্যাসের প্রথমে একটি চরিত্রের নামে।
- প্রফেসর বললেন না।
তারপর আরো একটু ভাবনা চিন্তা করে নীলাদ্রি বলল, - আচ্ছা ম্যাম এই চরিত্র?
তখন প্রফেসর তাকে বললেন,- আচ্ছা তুমি তো বললে চোখের বালি উপন্যাসটা তুমি করে ফেলেছো। তাহলে এই উপন্যাসের কে চোখের বালি সেটা বলতে পারছ না? তখন নীলাদ্রি একটু চুপে গেল। প্রফেসার তখন বললেন, আসলে তুমি অনার্স পড়ছো। অর্থাৎ তুমি এই বিষয়ে অনার্ড। তাই সাহিত্যের যা কিছু যখনই পড়বে তখনই খুব নিবিড়ভাবে, সচেতন ভাবে এবং সবচেয়ে বড় কথা অনেকটা বুঝে পড়তে হবে। আসলে এই উপন্যাস পড়া আমাদের একটি গল্প পড়ার মতো নয়।
- একথা নীলাদ্রিকে মারাত্মকভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাই সে ভাবলো সত্যিই তো গল্পের মতো করে উপন্যাসকে হয়তো সেভাবে দেখা যায় না। দেখতে হয় ঘটনার পরম্পরায়, কাহিনি বিন্যাসের আঙ্গিকে অথবা চরিত্রের উত্তীর্ণ হওয়ার পর্যায়। তাই আগেই সে যেভাবে শ্রীকান্ত পড়ে এসেছে সেভাবে কিন্তু চোখের বালি পড়তে পারল না। সে জানলো বাংলা সাহিত্যে প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস চোখের বালি। এই চোখের বালি উপন্যাস সত্যি করে নীলাদ্রির মফস্বল জীবন থেকে বেরিয়ে এসে মহানগরের জীবনকে বুঝতে সুবিধে দিল। কত কিছুই জানার বাকি রয়েছে। আর এরই সঙ্গে পড়তে হলো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বেশ কিছু উপন্যাস। বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, রজনী পাশাপাশি আরও একবার শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে উঁকি মারল গৃহদাহ উপন্যাস নিয়ে। আর তখনই মাথায় এলো লাইব্রেরির মেম্বারশিপতো হয়েই রয়েছে। তাহলে এবার থেকে কলেজ শেষ করে পড়াশোনার জন্য লাইব্রেরিতে যাবে। আর এই কথা ভাবতে ভাবতেই আসল কথা ওর মাথায় এলো। কাল সারারাত এই নিয়েই ভাবনা চিন্তা করেছে যদি কলেজ ফেরত আবার পড়াশোনা করতে হয় তাহলে লাইব্রেরি যেতেই হবে। আর লাইব্রেরি থেকে ফিরতে প্রতিদিন রাত হবে। ফলতো প্রতিদিন বাড়ি ঢুকে বড় মামার নানান রকম অবান্তর কথা তাকে শুনতেই হবে।
ক্লাস শেষ হতেই শুরু হল টিফিন টাইম। প্রতিদিনের মতোই ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়ল সুরের খাবারের জন্য। আজ অভিষেক ওদের পার্কে নিয়ে যাবে বলে কলেজ থেকে বেরিয়েই একটা গলিপথে ঢুকে পড়ল। --দুজনেই জিজ্ঞেস করল কোন পার্কে যাচ্ছি? অভিষেক বলল সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার পার্ক। তবে এই পার্ককে অনেকেই লেবুতলা পার্ক বলে জানে। নীলাদ্রি এই পার্কের কথা ছোটবেলা থেকেই শুনেছে। যতবার সে কলকাতার মামার বাড়িতে আসতো ততবারই এই পার্কের কথা সে শুনতো, হয়তো এমনও হয়েছে ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার এই পার্কে এসেছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের স্মৃতিতে সে সমস্ত কিছু আর মনে নেই। আজ এই পার্কের রাস্তায় যাবার পথ যেন তার কাছে একেবারেই নতুন। এ পার্কের রাস্তা যেন তার গ্রামের সেই বাগান পেরিয়ে আসার রাস্তার মতোই। মহানগরের বুকে বিরাট বিরাট অট্টালিকা, জাকজমকপূর্ণ দোকানপাট, শহরের বুক চিরে চলে যাচ্ছে সর্পিল আকারের ট্রাম লাইন, কত পোস্টার হোর্ডিং, কত নামিদামি তারকাদের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচার। কোথাও গয়নার বিজ্ঞাপন, কোথাও মশলার বিজ্ঞাপন, কোথাও জামা প্যান্টের বিজ্ঞাপন আবার কোথাও স্যানিটারী ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন সারা শহরকে ঘিরে। পরিষ্কার দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ এ শহরে সেভাবে চোখে পড়ে না। রাতের অন্ধকারে যে নক্ষত্র আলো চোখকে তৃপ্তি যোগায়, অনাশ্চর্যের মধ্যে আশ্চর্যের বাতাবরণ তৈরি করে হাজার হাজার নক্ষত্রের সমাবেশে, সেসব কোথায়! সবকিছুই যেন এখানে খুব বিরাটভাবে প্রতিপন্ন। যা তার ফেলে আসা মফস্বল শহরের সে নেহাতি দুর্গা পুজোর উৎসব ছাড়া সেভাবে কোনদিন পায়নি। আরো একটা দিক ওকে বেশ ভাবিয়ে তুলতো, সেটা হল শহরের বুকে অসংখ্য ছেলেমেয়েদের অকালপক্কতা। যেমন এই কলেজ পাশ করা ছেলেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তুমুল সিগারেট খাচ্ছে, বিভিন্ন পার্টি বা রেস্তোরাঁ গিয়ে নানা ধরনের খাওয়া দাওয়া এমনকি মদ্যপান -- এসব কিছু তার চোখের কেমন যেন অন্যভাবে ধরা দিয়েছিল। কোথাও যেন নিজেরই চিন্তার দ্বিধাদ্বন্দ্বে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ এই প্রশ্ন নিয়েই এক এক সময় তার দিন কেটে যেত। সে ভাবতো তাদের মফস্বল শহরের মানুষজনের মধ্যে কতটা সাজানো ডিসিপ্লিন চোখে পড়ে, অথচ এই শহরের বুকে মানুষদের মধ্যে সেরকম ডিসিপ্লিন নেই। আছে একটা ইংরেজি কায়দা। আছে ইউরোপীয় ধাপে একটা নিজস্ব স্টেটাস। তাই সবকিছু মিলিয়ে মাঝেমধ্যে মাথা ঘুরে যেত, উল্টোপাল্টা চিন্তা নিয়ে সে অনেকটা সময় একা থাকত। পার্কের দিকে যেতে যেতে চারিদিকের সমস্ত কিছু দেখে তার মাথার মধ্যে কি সমস্ত কথা ঘুরতে থাকলো। আর ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেল সেই বহুল পরিচিত লেবুতলা পার্ক। কত গোছানো, মানুষজন বিশ্রামের জন্য কত উপযুক্ত ব্যবস্থা। এরই একটা বসার জায়গায় তিনজনই বসলো। কথা হচ্ছিল কিভাবে পড়াশোনার প্যাটার্ন বা প্রস্তুতি তারা করবে। তিনজনের কথোপকথনে হঠাৎই সঞ্জয় বলল, আমার অসুবিধা কিছু নেই কাছ থেকে কাছেই লাইব্রেরি পারলে আমাদের একটা লোকাল লাইব্রেরিতেও মেম্বারশিপ নিয়ে নেব। এ কথা শুনে নীলাদ্রি বলল আমার নেওয়াটা একটু কঠিন হবে। আর একটা জিনিস নিয়ে খুব দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছি। অভিষেক সঞ্জয় দুজনেই বলল কী শুনি? নীলাদ্রি বলল, আসলে কলেজ পড়ে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করে বাড়ি ফিরতে গিয়ে প্রতিদিনই রাত হবে। আর প্রতিদিনই বাড়িতে একটু-আধটু অশান্তি হবে এবং ক্রমে ক্রমে সেটা বাড়তে থাকবে। তখন অভিষেক তাকে বলল আচ্ছা যদি তুই আমাদের বাড়িতে থেকে যাস?
-মানে?
- মানে কলেজ ফেরতা আমার বাড়িতে থেকে যাবি।
-তোর বাড়ি? অসুবিধা হবে না? (এই অনভিপ্রেত প্রস্তাব তাকে মুহূর্তের মধ্যে জীবনের অনেকটা অভিজ্ঞতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেল যেন। মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজের জীবনকে এবং তার বন্ধুর দেওয়া প্রস্তাব যেন তার কাছে আলাদিনের প্রদীপ এর মত আশ্চর্য এক প্রত্যাশী বস্তু হয়ে দাঁড়ালো। কী করবে বা কী বলবে সেটুকুই ভেবে উঠতে পারল না।)
- শুনে অভিষেক বলল, দূর অসুবিধা কি আছে। আমার বাড়িতে ঘর আছে। ছোট ঘর, তবে তোর অসুবিধা হবে না। বিন্দাস থেকে যেতে পারবি।
হঠাৎ কেমন যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মত নীলাদ্রি জীবনের পরিবর্তন হতে থাকলো। কোনভাবেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না যে এই শহরে যেখানে মানুষ মানুষকে এড়িয়ে চলে, হঠাৎ কোনো বিপদে হয়তোবা কোনা মানুষ কারুর পাশে থাকে না, যেখানে শুধুই অর্থের পেছনে মানুষ ছুটে বেড়ায় দিন থেকে রাত। এখানে এক কলেজের বন্ধু তাকে বাড়িতে থাকার জন্য বলছে! সত্যি তাই। চোখের কোনায় কোথাও যেন একটা আনন্দের জল জমে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে তার মহানগর সম্পর্কে সমস্ত দুশ্চিন্তা সরে গেল, বিরাট শহরকে যে আড়চোখ দিয়ে এতদিন ধরে দেখে এসেছে, আজ বৈশাখের অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব তার সমস্ত বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিল। সমস্ত বিশ্বাসের সমস্ত কল্পনার ঊর্ধ্বে এই বিরাট শহরের প্রকৃত ছবি তার চোখে ভেসে উঠলো। সে এতদিন শুধু এই মহানগরের বুকের উপর হেঁটেছে, হয়তো মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনি। আজ সেই মহানগরের অলিন্দ থেকেই প্রস্তাব তার শতচিন্তা হাজার দুর্ভাবনা কোথায় যেন দূরে সরিয়ে দিল। এতদিন ধরে সে যা যা ভেবেছিল তা সবকিছুই যেন মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল। সে শহরের হাজার হাজার মানুষের সাথে কোনদিন মেলামেশা করেনি, কিন্তু শহরের একটি বন্ধু বৎসল মানুষের সাথে মেলামেশা করে তার সম্পূর্ণ বিশ্বাস কোথাও যেন আবার নতুন করে বাসা বাঁধতে শিখল। মুহূর্তের মধ্যেই সে অভিষেক কে বলল -- বেশ তাহলে তাই হবে বুঝলি? যেদিন যেদিন লাইব্রেরি যাব সেদিন তাহলে আর বাড়ি ফিরব না। তোর কাছেই থেকে যাব। শুনে অভিষেক বলল হ্যাঁ। কোন অসুবিধা হবে না। চল ওখানে ভালো পরোটা করে দুটো করে খেয়ে নি।
Comments