“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৯
এবার থেকে নীলাদ্রি একটা ভরসা পেল। আর যাই হোক নিজের শহর ছেড়ে এই যে বড় শহরে এসে এখানে থেকে পড়াশোনা করার যে প্রচেষ্টা, সেটা জানো আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবার একটা রাস্তা খুলে গেল। সত্যিই তো এত বড় শহরে এই কদিনের বন্ধুর তালিকায় অভিষেক যেন কোথাও তার কাছে একটা বড় সম্ভাবনা এবং একই সাথে বিরাট একটা আস্থা যেন তৈরি হয়ে উঠল ওর নিজের মনে। যখনই যেভাবেই হোক এবার তাহলে নিজের মতো করে ওকে সবটা বলা যাবে। হয়তো এই কথাগুলোই এতদিন ধরে নীলাদ্রি নিজের মনে চেপে পুষে রেখেছে। এদিকে কলেজের পড়াশোনার চাপ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। যেহেতু বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়তে হচ্ছে তাকে, সেহেতু পড়াশোনার পাশাপাশি আরো নানা ধরনের পড়াশোনা তাকে অবশ্যই পড়তে হবে -- প্রায়শই এই ধরনের কথাবার্তা ও কলেজের প্রফেসরদের থেকে শোনে। আসলে অনার্স পড়তে আসা মানে অনেকটা বেশি পড়াশোনা, অনেকটা বেশি জানা, বিষয়ের প্রতি গভীর জ্ঞান আরোহন করা এসব কিছুই অনার্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর তাই কোনোভাবেই নীলাদ্রি এই অনার্স কি তাচ্ছিল্য করতে পারে না। তাই দিন হোক বা রাত প্রতিনিয়তই পড়াশোনার মধ্যে থাকতে থাকতে কেমন যেন পড়াশোনাটাকে তার অনেকটা ভালো লাগতে লাগলো। প্রতিনিয়ত বই কেনা, বই পড়া, এরই সঙ্গে লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করা এসব কিছুই একটা রুটিন মাফিক তার জীবনে শুরু হয়ে গেল।
এই করতে করতেই পুরো একটা বছর শেষ হয়ে গেল। প্রথম পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। প্রথম পরীক্ষা সিট পড়ল চিত্তরঞ্জন কলেজে। বলা যেতে পারে নিজেদের কলেজ বাদ দিয়ে এই প্রথম তার আরও একটা কলেজকে দেখা। এই কলেজ তাদের কলেজের থেকে এ মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। যদিও প্রথম বছরের পরীক্ষায় সেরকম প্রেসার না থাকলেও পাস কোর্সের পেপারগুলো নিয়েই বেশি চিন্তা হয়। আর অনার্সের পেপার সেই সময় এই পার্ট ওয়ানের পরীক্ষায় সাধারণত থাকে না। তাই পাশের সাবজেক্টগুলোর পরীক্ষা যেন কেন প্রকারের দিলেও চলবে না। অন্তত ভালোভাবে দিতেই হবে যাতে নম্বরের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা না হয়। এইরকমই কথা মাঝেমধ্যেই পরীক্ষার আগে তার কানে এলো। আর অসামানেই একটু বিচলিত হয়ে যাওয়া। তাই ভাবল আর যাই হোক পাশ পেপারে রেজাল্ট ভালো করতেই হবে। আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে এলো। পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিল নিজের কলেজ থেকে। এরপর যা হয় আর কি পরীক্ষার আগে টানা বেশ কিছুদিন কলেজ অফ, এবং রীতিমতো বাড়িতে পড়াশোনা। যেদিন কলেজে পরীক্ষার ডেট নোটিশ টাঙিয়ে দিল সেদিন নীলাদ্রি অভিষেককে বলল ওর বাড়িতে থেকেই পরীক্ষা দেবে। অভিষেকও ওর কথায় রাজি। এরপর সেই পরীক্ষার দিন প্রায় চলে এলো। দিন দুয়েক আগে নীলাদ্রি অভিষেকের বাড়িতে চলে গেল ওখান থেকেই পরীক্ষা দিতে যাবে। তাই মামার বাড়িতে বলে গেল যে পরীক্ষা চলবে তার জন্য এই কদিন সেই কলকাতার বন্ধুর বাড়িতেই থাকবে। এখানে আর আসবে না। একেবারে পরীক্ষা শেষ হলে আসবে। তাই বইপত্র মোটামুটি গুছিয়েগাছিয়ে দিন দুয়েক আগেই মামার বাড়ি ছেড়ে চলে গেল অভিষেকের বাড়ি। দিন দুই পর পরীক্ষা শুরু হল, চলল টানা দিন দশেক। এরপর পরীক্ষা শেষে আবার ফিরে এলো মামার বাড়িতে। এখন বেশ ক'দিন ছুটি। পরীক্ষা সদ্য শেষ হয়েছে। রেজাল্ট বেরোতে মাসখানে কি তার বেশিও লাগতে পারে। তাই এখন মামার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা এবং তারই সঙ্গে লাইব্রেরীর কাজ।
মামার বাড়িতে, একদিন মাইমা ওকে ডাকল ওপরে। প্রতিদিন বিকেল হলেই নীলাদ্রি একটু এই শহরে গঙ্গার ধার, মাঠে বেড়াতো। আর সন্ধ্যের সময় বাড়ি ঢুকে যেত। তারপর দিদা প্রায় প্রতিদিন গরম গরম চপ আনাতে দিত, তারপর চপ মুড়ি আর চা, এই ভাবেই সন্ধ্যের টিফিন সেরে নিতো। সেদিন যখন মাইমা ওকে ওপরে ডাকল, তখন ও গেল ওপরে।
- মাইমা বলল, আয় ঘরে। বোস। কিছু খাবি? চা করব?
- নীলাদ্রি বলল, আচ্ছা একটু শুধু চা খাই।
- মাইমা বলল, শোন তোর মা ফোন করেছিল। ওদিকে তোদের একটু বিষয় সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা চলছে। টাকা পয়সা পেতে একটু দেরি হবে। তাই তোর যেগুলো টাকা পয়সা মাসের দেওয়া থাকে, সেগুলো একটু লেট হবে।
একথা যদি নীলাদ্রির কাছে নতুন নয়, কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে এই বিষয়টা অনেকটা ওকে বিচলিত করল। মাইমা ওকে একটু বিচলিত হতে দেখে বলল, কী হলরে? কিছু হলো? ইতস্তত একটু অন্যমনস্ক হয়ে নীলাদ্রি বলল, - না না কিছু না। এই একটু ভাবছি। টাকা পাওয়া বলতে প্রতিদিন যে লঞ্চ পেরিয়ে ওপারে যায়, ওখানে সাইকেল গ্যারেজের ভাড়া, আর লঞ্চের ভাড়া। আর ট্রেনের একটা মান্থলি টিকিটের খরচ, এই তিনটে টাকা তো ওকে জোগাড় করতেই হবে। এই চিন্তা করতে করতে নিচে নেমে এলো। হঠাৎ যেন একটা ধারাবাহিকতা থেকে জোর ধাক্কা খাওয়া। ওর মামার বাড়ির কাছে গঙ্গা বয়ে গেছে। রয়েছে একটা বড় শিব মন্দির ঘাট। কাউকে কিছু না জানিয়ে, টুক করে একটু একা থাকার জন্য ও সেই মন্দিরের চাতালের ঘাটে গিয়ে বসলো। পশ্চিম পাড়ে যেন চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো গঙ্গার বুক জুড়ে ভেসে আছে। অবিরাম গঙ্গার ধারে বসে জলের স্রোতের ওপর কিল কিল করে ভেসে যাওয়া চাঁদের আলোর ঝলকানি দেখতে থাকলো। একটা কথা এই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো কি করে এগুলো ম্যানেজ হবে। আদৌ হবে তো।
পরদিন বিকেল বেলায় ওর মাইমা আরো একবার ওকে উপরে ডাকল। সেদিন বড়মাইমাও ছিল ওপরে। তারা দুজনেই তাকে ডেকে বলল, নীলাদ্রি তুইতো পড়াশোনা করছিস এবার সেকেন্ড ইয়ার। তুই একটা কাজ করতে পারিস। সেটা হলো অবসর সময়ে কিছু টিউশন পড়তে পারিস। আমাদের এখানকার ছেলেমেয়েরা অবসর সময়ে টিউশন পড়ে নিজেদের হাত খরচা চালায়। দুটো কি তিনটে টিউশন যদি করতে পারিস তাহলে অন্তত নিজের কলেজ যাওয়ার খরচ থেকে আনুষাঙ্গিক দু তিনটে কাজ অনায়াসেই তোর হয়ে যাবে। এই প্রসঙ্গেই বড় মাইমা নিজের ছেলের প্রসঙ্গের কথা মিলার দিকে শোনালো। ওদিকে ছোট মাইমাও এই শহরের কিছু ছেলে মেয়ের কথা বলল যারা কলেজে পড়াশোনা পাশাপাশি হাত খরচা ও নিজের খরচ চালাতে অনেকেই টিউশন করে। কথাগুলো সোনা মাত্রই নীলাদ্রি যে খুব একটা হতাশায় পড়ে গেল এমনটা নয়, বরঞ্চ ওর ভালই লাগলো যে যদি অবসর সময়ে দু একটা টিউশন এসে করতে পারে তাহলে নিজের খরচের সাথে কলেজ যাওয়া আসা বা কলেজের খরচাটুকু সে নিজেই সামলাতে পারবে। এবং এই সামান্য করা টাকার জন্য অন্তত তাকে বাড়ির প্রতি হা-পিত্তেস করে বসে থাকতে হবে না। কিন্তু এই ছোট্ট মফস্বল শহরে তাকে চেনে কে? কিংবা তাকে দু একটা টিউশনের সন্ধান দিতে পারে? এই শহরের আসার পর থেকে কোনদিনই সেভাবে ও কারো সাথে মেলামেশা করেনি। সুতরাং বন্ধুবান্ধব বা পরিজন বলতে এই মামার বাড়ির লোকজন ছাড়া তার আর কেউ নেই। তাই রীতিমতো একটু দুশ্চিন্তা যেন থেকেই গেল। যদিও ওর মাইমারা ওকে কিছুটা আশ্বাস দিলো, যে যদি কোন টিউশনের সন্ধান পায় তাহলে ওরা ওকে অবশ্যই দেবে। ছাত্রাবস্থায় টিউশনি তে মূলত শূন্য দশকের বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের বলা যেতে পারে, প্রথম চাকরি। এবং একই সঙ্গে প্রথম উপার্জনের পথ। যদিও সত্যের দশকে বা আশির দশকে অথবা নয় এর দশকে এই ধরনের একটা প্রচলন ছিলই। কিন্তু নয় দশকের পর শুন্য দশকে সারা পৃথিবীর যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এমনকি মানব সভ্যতার ইতিহাসে মোবাইল যন্ত্রের বিরাট একটা ব্যবহার, সেখান থেকে এই টিউশনির কাজটা একটু কঠিনই ছিল নীলাদ্রির ক্ষেত্রে। তারওপর নীলাদ্রির তেমন কোন পূর্বের অভিজ্ঞতাও নেই। তাই প্রথমে তাকে টিউশনি জোগাড় করতে হলে মোটামুটি পরিচিতদের হাত ধরেই তাকে টেনশনে পেতে হবে। আর এই টিউশন করতে হবে এবং টিউশন পেতে হবে এই চিন্তা ভাবনা করতে করতেই তার মাস গড়িয়ে গেল। এরপর একদিন পাশের বাড়ির এক পরিচিত ব্যক্তি তাকে রাস্তায় দেখা হলে ডাকলেন। বললেন ভাই তুমি টিউশন পড়াও?
- শুনে নীলাদ্রি বলল না টিউশন পড়ায় না। তবে টিউশন পেলে সে অবশ্যই পড়াবে।
- ভদ্রলোকটি বলল আমার নাতিটাকে তোমাকে খালি একটু ঘন্টা দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে।
- এ কথা শোনা মাত্রই যেন হাতে চাঁদ পেলেও নীলাদ্রি। সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যুত্তরে বলল অবশ্যই কেন পড়াবো না।
- ভদ্রলোকটি বলল বেশ তাহলে কালকে বিকেল বেলায় একবার আমার বাড়িতে এসো। সাক্ষাতে কথা হবে।
- নীলাদ্রিও বলল আচ্ছা বেশ আগামী কাল যাব।
পরদিন বিকেল বেলায় নীলাদ্রি এ পাড়া থেকে পাশের পাড়ায় সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে গেল। এবং সেখানে তার ছোট্ট নাতি ক্লাস ফাইভে পড়ে তাকে সমস্ত সাবজেক্ট পড়াতে হবে। ঘুম থেকে শুক্র পর্যন্ত ক্লাস। শনি রবি পুরোপুরি ছুটি। আর মাইনে দেবে ৮০ টাকা। এতকিছু কথায় ভদ্রলোক অনায়াসেই নীলাদ্রিকে বলে দিল। এরপর জিজ্ঞেস করল তাহলে তুমি রাজি তো?
- মোটামুটি এই কথা শুনেই নীলাদ্রি রাজি হয়ে গেল। সে মনে মনে তখন ক্যালকুলেট করতে লাগলো প্রতিদিনের সাইকেল ভাড়া এক টাকা করে হলে মাসে ত্রিশ টাকা। আর কলেজে যেতে আসতে লঞ্চ ভাড়া লাগে চার টাকা। অর্থাৎ আর যাই হোক তার কলেজ যাওয়াটা খুব একটা অসুবিধা হবে না। যদিও এখন সে সেকেন্ড ইয়ার, কলেজে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত যেতে হয় এমনটা নয়। কিন্তু একেবারেই কিছুই না করার থেকে, কিছুটা শুরু করে দেওয়া অনেকটাই ভালো। তাই সে সেই ভদ্রলোক কে তখনই জানালেন বেশ আগামী সোমবার থেকে সে পড়াতে আসবে সকাল সাতটায়। সাতটা থেকে নটা পর্যন্ত ঘন্টা দুই সে পড়াবে।
এরপর আসন্ন সোমবার থেকে নীলাদ্রি টানাপড়ানো শুরু করে দেয়। ধারাবাহিকভাবেই পড়ানো লাইব্রেরী এবং তারই পাশাপাশি নিজের কলেজ এভাবেই চলতে থাকলো সময়। এক মাস পড়ানো প্রায় শেষ। দিন এগিয়ে এলো মাইনে পাওয়ার। যেদিন মাইনে পাওয়ার ডেট ছিল সেই দিন সকালের নীলাদ্রি একটু আগেই পৌঁছে গেছে। যে ছেলেটিকে পড়াতো সেই ছেলেটির মা ও একটু চমকে গেছে নীলাদ্রিকে দেখে, যে একটু আগে পড়াতে চলে এসেছে। আসলে ওইদিন নীলাদ্রির কাছে ছিল বিশেষ একটা দিন। এক মাস টানা পড়িয়ে শুধুমাত্র এই দিনটির জন্য সে অপেক্ষা করেছিল যে আজ মাস মাইনের টাকাটা সে হাতে পাবে। তাই সকাল থেকেই একটু চঞ্চল ও অস্থির হয়ে পড়েছিল যতক্ষণ না পর্যন্ত মাইনের টাকাটা হাতে পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ছেলেটির মা তার জন্য চা জল নিয়ে ঘরে ঢুকলো এবং নীলাদ্রিকে ডেকে তার হাতে আশি টাকার মাইনে দিল।
আশি টাকা। হ্যাঁ পৃথিবীর জন্মের প্রায় সাড়ে চার কোটি বছর অতিক্রান্ত আজকের বর্তমান সময়। যে সময় দাঁড়িয়ে টাকার মূল্য এবং টাকার গুরুত্ব প্রতিটি মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা মৌলিক ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ সে একমাস অতিক্রম করেছে পেয়েছে সারা মাস পড়িয়ে মাসের টাকা। আর এই টাকা হাতে পেয়েই সে ছোট্ট করে একটা পরিকল্পনা করে ফেলল। সাইকেল গ্যারেজ কে সে এত টাকা দেবে, প্রতিদিন যাতায়াত খরচার জন্য এই টাকাটা তার অবশ্যই খরচ হবে - এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তার ছাত্র তাকে বলল স্যার লেখাটা হয়ে গেছে দেখে নিন। একটু বিষন্ন চিন্তিত হয়ে বলল -- ও লেখাটা হয়ে গেছে দাও দেখেদি। ছেলেটির খাতায় যে সমস্ত প্রশ্ন নীলাদ্রি দিয়েছিল প্রত্যেকটি প্রশ্নই ছেলেটি ঠিক উত্তর দিয়েছে। নীলাদ্রি প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তরে ঠিক চিহ্ন দিতে দিতে গেল। আর এই সময় সে চিন্তা করতে লাগলো আগামীদিনে যে যে কাজগুলো তার সামনে আসবে অথবা যে সমস্যাগুলো তার কাছে এসে বাধা দেবে, তাকে ঘিরে ধরবে, কিছুতেই সামান্য থেকে সামান্যতম সময় তাকে দেবে না কিছু ভাবার কিছু করার, সেগুলো যেন সব ঠিক ঠিক চিহ্নের মত সমাধান হয়ে যায়।
Comments