ছোট গল্প— মৌলীনাথ গোস্বামী

 













শেষ সম্বল

  “এখন কেমন বোধ হচ্ছে, গিরি?” যতটা সম্ভব মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করে, একটা ওষুধের বাক্স হাতে নিয়ে, বাক্সের গায়ের লেখাগুলোয় মন দেয় অর্ণব। ইচ্ছে করেই এমন করে। আবহাওয়া যতটা সহজ রাখা যায়। ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয়নি।

এপ্রিল শেষের দুর্দান্ত গরমে কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে শীর্ণ, কঙ্কালসার একটা লোক, কতই বা বয়স হবে, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ, নিঃসাড়ে, ধীর পায়ে অর্ণবের মুখোমুখি এসে বসে। গোটা মুখ জুড়ে শূন্যতার থমথমে কালচে প্রলেপ। গায়ের ঢলঢলে হাফহাতা জামাটা শরীরের ওপর কোনোরকমে আটকে আছে।  

“খিদে একদম নেই ডাক্তারবাবু। কোনোরকমে দু-একগাল... প্রচণ্ড গ‍্যাস হচ্ছে। চাপতে পারছি না। পেটে খিঁচ ধরাটা বেড়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা। শুরু হলে থামতেই চায় না। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসে ডাক্তারবাবু...,” মিনমিন করে লোকটি। 

শেষের বাক্যটি যেন গিরি নামের মানুষটির মুখ থেকে কী এক অনির্বচনীয় হাহাকারের সাথে বেরিয়ে আসে। সে ধাক্কায় চোখ না তুলে থাকতে পারে না অর্ণব। বুকটা ধক করে ওঠে। এ কী চেহারা হয়েছে গিরির! তাকানো যাচ্ছে না! এক মাসে এত অবনতি! তবে কি...

“খিদে হওয়ার যে ওষুধটা দিয়েছিলাম, আছে না শেষ হয়ে গেছে?” ধাক্কাটা অপরদিকের লোকটাকে টের পেতে না দিয়ে খুব ক‍্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করে অর্ণব।

“শেষ।” 

“খেয়ে উপকার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে?”

উত্তর আসতে দেরি হয়। লোকটা হয়তবা উত্তর হাতড়ায়। কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে বলে, “কে জানে। কিছু খেতে তো আর ইচ্ছে হয় না, ডাক্তারবাবু। জোর করে দু’বেলা দু’মুঠি যাহোক গিলি। খেয়ে কী হবে তাও জানি না।”

“হমম!” গম্ভীর হয় অর্ণব। “পাল্টে অন্য ওষুধ দেব এবার। একটু দাম বেশি, তবে রিপোর্ট ভীষণ ভালো। খিদে হবে। চিন্তা কোরো না। পায়খানা কেমন হচ্ছে?”

“আজ্ঞে যেমন ছিল তেমনই। বিষ কালো। আর কেমন হবে?” রুগীর গলা থেকে স্পষ্ট হতাশা ঝরে ঝরে পড়ে।

“ঠিক আছে। খিদের যে টনিকটা এবার লিখে দেব ওতে দেখবে পায়খানার রং ফর্সা হয়ে গেছে। আর দুটো ট্যাবলেট লিখে দিচ্ছি, এগুলো এখানে ফার্মাসি থেকে পেয়ে যাবে। পনেরোদিনের ওষুধ লিখে দিলাম। আমি কাল থেকে ছুটিতে যাচ্ছি। এসে ফের তোমায় দেখব। এই ক’দিনের জন্য যা যা লিখে দিলাম খাও। আমি জয়েন করলে পর জানিও।” ঘাড় গুঁজে ফসফস করে ওষুধ লিখে দেয় অর্ণব। কেন যেন গিরির চোখে চোখ রাখতে দুনিয়ার তামাম অস্বস্তি হামলে পড়ছে ওর ওপর।

“আপনি চলে যাচ্ছেন?” কঁকিয়ে ওঠে গিরি। 

“আরে! চলে যাচ্ছি কোথায়? বিয়ে করব, শুনলে না? ক’দিনের ছুটি নিচ্ছি। তাছাড়া, আমার রিলিভিং ডক্টর থাকবে তো। তোমার যখন এমার্জেন্সি মনে হবে চলে আসবে। আমি ওঁকে বলে রাখব। একদম দুশ্চিন্তা কোরো না।” উৎসাহ দেয় অর্ণব। ওর ছুটির আকস্মিক সংবাদে গিরি তবু থমকে বসে থাকে।

“আমার কাজ আছে, গিরি। চার্জ হ্যাণ্ডওভার করতে হবে। ওষুধের হিসেব আছে। আরও পেশেন্ট আছে, তাদেরকেও দেখতে হবে। কেন চিন্তা করছ? দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে যাবে। আর, নতুন ডাক্তারবাবু তো রইলই।” গিরিকে মিষ্টি কথায় বিদায় করতে চায় অর্ণব।কালো মুখ আরও অন্ধকার করে নিঃশব্দে উঠে পড়ে গিরি। 

“বিয়ে কবে, ডাক্তারবাবু?”

“পরশুদিনের পরদিন। কত কাজ বলো তো? গোছগাছ, কেনাকাটা...” 

“এখানে আবার ফিরে আসবেন তো? পনেরোদিন... সত্যি বলছেন?”

হেসে ফেলে অর্ণব। “হ্যাঁ, রে বাবা। ট্রান্সফার তো নয়। বিয়ে। এখানেই ফিরে আসব তোমাদের ম্যাডামকে নিয়ে। তখন বিশ্বাস হবে তো?”

কেমন ভ্যাবলার মতন মাথা হেলায় গিরি। “আচ্ছা, আসি তবে। নমস্কার। অনুষ্ঠান ভালোভাবে মিটে যাক। আর কী বলব!” প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে ফার্মাসির দিকে এগোয় সে। অর্ণব পরের পেশেন্টে মনোনিবেশ করে। কিন্তু মন দিতে পারে না। বাকি যে কয়েকটা গ্যাস্ট্রিক আর সর্দিকাশির রুগী ছিল, তাদের জন্য গতানুগতিক প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতেও গিরির মুখটা বারবার মনে পড়ে যায় অর্ণবের।

সন্ধ্যায়, কোয়ার্টারে ফিরেও, নিজের আসন্ন বিয়ের উন্মাদনা ছাপিয়েও বড় বেশি করে ওকে তোলপাড় করে গিরির হাড়-জিরজিরে চেহারা। মুমূর্ষু গিরি। ফোর্থ স্টেজ কোলন ক‍্যান্সারে আক্রান্ত গিরি। হাতেগোনা কয়েকটা অনিশ্চিত দিন অথবা সপ্তাহের মালিক গিরি। ‘ধর্মরাজ গিরি শাড়ি স্টোর্স’- এর হাতেগোনা কয়েকখানি শাড়ির মালিক, গিরি।     

হাত-পা ধুতে ধুতে কেবলই পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ছিল অর্ণবের। খুব পুরোনো তো নয়! গত বছরের ফেব্রুয়ারি। পোস্টিং নিয়ে সবেমাত্র গোয়ালডাঙা ব্লক হেল্থ সেন্টারে এসেছে সে। সন্ধ্যায়, হাসপাতালের কাজের চাপ কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেলে, কোয়ার্টারে ফ্রেশ হয়ে চায়ের অন্বেষণে বেরুনো। নতুন জায়গা, নতুন মানুষজন। কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে বাসস্টপের দিকে যেতে, বড়রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানের একটু আগেই বাঁহাতে ‘ধর্মরাজ গিরি শাড়ি স্টোর্স।’ প্রথম দিনই খেয়াল করেছিল অর্ণব। সারিবদ্ধ অনেকগুলো দোকানের মাঝে সাদা বাল্বের আলোয় জ্বলজ্বল করছে দোকানের সাইনবোর্ড। লম্বা একফালি দোকান। কাচের শো-কেস। কয়েকটা শাড়ির থাক। শো-কেসের বেশিরভাগটাই ফাঁকা। একটি মানুষ একাহাতে কাউন্টারের ওপর শাড়ি ফেলে দেখিয়ে চলেছে। টিউবলাইট জ্বলছে দোকানের ভেতর। দু-তিনজন খদ্দের...   

একদিন নয়। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় চা খেতে বেরিয়ে দোকানটি খেয়াল করেছে সে। একই চিত্র। টিউবলাইটের করুণ আলোর আবহে শাড়ি দেখাচ্ছে এক দোকানদার।

“নাম কি?” আগস্টের এক দুপুরে এক পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিল অর্ণব।

“আজ্ঞে, সমীরণ গিরি।”

“কী করা হয়?”

“শাড়ির দোকান, আজ্ঞে। ধর্মরাজ গিরি শাড়ি স্টোর্স। এই আপনার হেল্থ সেন্টারের কাছেই।” জবুথবু লোকটা উত্তর দিয়েছিল। চমকে উঠেছিল অর্ণব। সন্ধেবেলা এই লোকটাকেই তো দোকানে দেখে সে! কিন্তু একে তো লোক বলা যায় না। বড়জোড় বয়স্ক ছোকরা। সেদিনের প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ে গেল অর্ণবের। তখনও কত ঝলঝলে ছিল লোকটা। সাধাসিধে মানুষ। একগাল হেসে নিজেই যে-চে বলেছিল, “খদ্দের নাই, ডাক্তারবাবু। লোক হয় না। ওই কোনোরকমে চালাই দোকানটা। দু-মুঠো ভাতের খরচ উঠে আসে। একা মানুষ...,”  

“একা কেন? পরিবার নেই?”

“আজ্ঞে না। বাপ মরল। বাপৈত সম্পত্তি ভাগবাঁটরা হল। দাদারা ভেন্ন করে দিলে। বিয়েশাদি করি নাই... কিছু তো করে খেয়ে বাঁচতে হবে। ছোট একটা দোকান দিলাম বাপের নামে। সেই থেকে চলছে।”  

“খদ্দের নাই কেন বললে? সন্ধ্যায় দেখি যে, লোকে শাড়ি দেখছে!”   

“ওই আরকী! বিক্রিবাটা তো তেমন হয় না। গাঁ-গঞ্জের ব্যাপার বোঝেনই তো। তাছাড়া নতুন কয়েকটা দোকান হয়েছে। ঝাঁ-চকচকে। আমার অত পুঁজি কোথায় যে সবরকমের শাড়ি রাখব। মহাজনের কাছে ধার বাকি রেখে শাড়ি তুলি। তাঁত। সদরে তাঁতিঘর থেকে বুনিয়ে আনা। বছর দশেক হতে চলল। একসময় খুব দৌড়ঝাঁপ করতাম। এই গেল বচ্ছরও মেলা ছোটাছুটি করেছি। কিন্তু আর পারছি না যেন।” উত্তর দিয়েছিল সমীরণ গিরি।  

“কেন? কী হয়েছে?”

“সারাদিন ক্লান্ত লাগে আজকাল। পেটটাও ভালো যাচ্ছে না।” 

“কী অসুবিধে?”

“মাঝেমাঝেই পাতলা পায়খানা হচ্ছে। লালচে। সঙ্গে গ্যাস। তাই তো আপনাকে দেখাতে এসেছি।” 

সেই প্রথম আলাপ আর রুগী-ডাক্তারের সম্পর্কের শুরু। এবং ক্রমে, রোগের কল্যাণে মানুষটার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া।       

দরজায় তালা দিয়ে রোজকার মতন চা খেতে বেরিয়ে অর্ণব খেয়াল করল, ‘ধর্মরাজ গিরি শাড়ি স্টোর্স’-এর ঝাঁপ বন্ধ। দোকানের সামনেটা অন্ধকার। উৎকণ্ঠিত হল সে। গিরির কি কিছু বাড়াবাড়ি হল? নয়ত দোকান তো বন্ধ থাকে না সন্ধ্যায়! বিক্রি হোক বা না হোক। এই এক বছর ধরে অর্ণব খেয়াল করেছে, কীভাবে ভাঙনের মাটির মতন একটু একটু করে খসতে খসতে গিরির দোকানের শাড়ির স্টক তলানিতে এসে ঠেকেছে। কাচের শো-কেস এখন খাঁখাঁ করে। পাল্লার গায়ে ধুলো জমেছে। দোকানে সাকুল্যে দশ-পনেরটা শাড়ি হয়তবা পড়ে আছে আর। নতুন শাড়ি তোলা বন্ধ হয়ে গেছে বেশ অনেক মাস হল। আজকাল কাউন্টারে স্থবিরের মতন বসে থাকে নিঃসঙ্গ গিরি। রাস্তার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। 

চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় অর্ণব। মনে পড়ে যায়, আগস্টের সেই প্রথম সাক্ষাতের পরে আরও কতবার হেল্থ সেন্টারে এসেছে গিরি। কত ওষুধ, কত পথ্য লিখে দিয়েছে অর্ণব। কাজের কাজ কিছু হয়নি। গিরির সমস্যা জটিল থেকে ক্রমশ জটিলতর হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে অখিদে, কালো পায়খানা, পেটে যন্ত্রণা, গ্যাস, ক্লান্তি জেঁকে বসেছে গিরির ওপর।

অর্ণব সাস্পেক্ট করেছিল। ওর শিক্ষিত আশঙ্কা সত্যি হতে বেশি সময় নেয়নি। মহালয়ার দিন দুয়েক আগে গিরিকে কয়েকখানা টেস্ট লিখে দিয়েছিল সে। প্রথমে পায়খানা পরীক্ষা। সেটা হেল্থ সেন্টারে হয় না। এমনকী মহকুমা হাসপাতালেও না। জেলা সদরে গিয়ে করিয়েছিল গিরি। প্রাইভেটে। 

রিপোর্ট পড়ে অর্ণবের বুকটা ছ‍্যাঁৎ করে উঠেছিল। কোলন ক্যানসার! রিপোর্টের ভাষা পড়তে না পারলেও, অর্ণবের মুখের ভাষা চকিতে পড়ে ফেলেছিল গিরি।      

“ভালো নয়, না ডাক্তারবাবু?”

“হ্যাঁ, না, মানে... তেমন কিছু নয়। একটা কোলোনোস্কপি করতে হবে তোমায়, সাথে বায়োপ্সি। নাহলে, আমি কোন গ্রুপের ওষুধ দেব সেটা স্থির করতে পারব না। তোমার সমস্যাটা একটু জটিল। তবে ঘাবড়াবার কিছুই নেই এতে।” যতটা সম্ভব সহজ গলায় গিরিকে বলেছিল। হাজার হোক, সে তো ডাক্তার। তাকে আশা হারাতে নেই। রুগীকেও আশাহত করতে নেই। বিশেষত এমন একটা মানুষকে, যার কেউ নেই।     

 অর্ণবের মনে আছে, গিরি কিছুতেই কোলোনোস্কপি করতে যাবে না। কেবলই বলে, ওকে ওষুধ লিখে দিতে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো হয়েছিল। সদরের এক নামকরা টেস্ট-সেন্টারে গিরিকে পাঠিয়েছিল সে, শুধুমাত্র নিখুঁত রিপোর্টের আশায়। হাজার দশেক টাকার ধাক্কা। টাকা এবং টেস্টের জোড়া ধাক্কা সয়েছিল গিরি, কিন্তু কফিনের শেষ পেরেকের মতন, রিপোর্টের ধাক্কা সামলাতে কষ্ট হয়েছিল অর্ণবের। লাল কালিতে দগদগ করছে বায়োপ্সি রিপোর্ট। কোলন ক‍্যান্সার। স্টেজ ফোর। কোনও ভীষণ চালু শাড়ির দোকানের শো-কেসে ঠাসা সার সার শাড়ির মতন, পলিপে পলিপে গিজগিজ করছে গিরির বৃহদান্ত্র। অবস্থা হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে, টের পেয়েছিল সে। সেই প্রথমবার কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব জুড়ে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী দামামার নিঠুর শব্দ হৃদয়ঙ্গম করেছিল তরুণ অর্ণব। পেশায় ডাক্তার হলেও, আদতে তো সে একটা সাধারণ মানুষই। বাঁচতে চায়, বাঁচাতে চায়। ভীষণভাবে বাঁচাতে চেয়েছিল। সাধাসিধে গিরির প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছিল ওর। বলেছিল, “গিরি, আমি শুধু ঠেকা দিয়ে যেতে পারি এখান থেকে। বেশিরভাগ কাজটা তোমাকেই করতে হবে। সার্জারি আর কেমোথেরাপি ছাড়া কোনও পথ নেই। আমি রেফার করে দিচ্ছি। চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হস্পিটালে ভর্তি হয়ে যাও। ওখানে আমার এক পরিচিত ডাক্তার আছেন। আমি নোট লিখে দিচ্ছি।”   

বিচলিত অর্ণব, দ্বিতীয় চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে থম মেরে বসে থাকে। ওদের সেইদিনের সাক্ষাতের ছবিগুলো স্লাইড-শোয়ের মতন পরপর ভেসে উঠছিল ওর চোখের সামনে। সব শুনে মুখ কালো করে গিরি বলেছিল, “এ জায়গা ছেড়ে কোথায় আর যাব? তাছাড়া, আমি একা মানুষ। আমার আগুপিছু কেউ নেই। আমার জন্য অপেক্ষা করারও কেউ নেই, ডাক্তারবাবু। আর আমার সে আর্থিক সামর্থও নেই যে দেখাশোনা করার লোক রাখব। এই এক বছর ধরে ওষুধ-পথ্য আর টেস্টের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। শাড়ি বাবদ এখনও প্রচুর টাকা মহাজনকে দিতে বাকি। ধারের ব্যবসা যেমন বেশিদিন চলে না, ধারের জীবনও বেশিদিন টেঁকে না ডাক্তারবাবু। তাঁর চেয়ে বরং যেমন চলছে তেমনই চলুক। আপনার ওষুধ যখন আমায় এতদিন ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে, আগেও রাখবে। আপনি চিন্তা করবেন না।”

বেশ মনে আছে অর্ণবের, গেল বছর পুজোয় শাড়ি তোলেনি গিরি। শো-কেসে যা পড়ে ছিল, একটা দুটো করে তিলে তিলে বিক্রি করে গেছে। আয়ুর অদৃশ্য দেয়াল-লিখন চোখের সামনে টাঙিয়ে রোজ দোকানে বসেছে। এখনও বসে। একদিনও দোকান বন্ধ করেনি। সময়ের হাত ধরে শাড়ির সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে একটু একটু করে কমতে থেকেছে গিরির জীবনের মেয়াদ। দোকানের মতোই কৃষ থেকে কৃষতর হয়েছে ওর হাত, পা, মুখ, পেশী। চোখ কোটরের অন্ধকারে তলিয়েছে। ক্রমশ শুকিয়ে আসা মাংসপেশী ছাপিয়ে প্রকট হয়েছে হাড়-পাঁজরা। ঝলঝলে প্রাণবন্ত একটা মানুষের চোখের চাহনি ক্রমে মরা মাছের ভাষাহীন চোখে বদলে গেছে...   

শূন্য ভাঁড়খানা অন্ধকারে ছুঁড়ে দেয় অর্ণব। কেমন যেন অস্থির লাগে। গিরির দোকান বন্ধ কেন? কিছু কি হল ওর? কী হল? মরে যায়নি তো? অপ্রিয় হলেও, ওর মন এই বাক্যটা শেষমেশ উচ্চারণ করেই ফেলে।    

কোয়ার্টারে ফেরার পথেও দেখে বন্ধ দোকানখানা অন্ধকারে তেমনই ডুবে আছে। স্যুটকেস বের করে জামাকাপড় গোছাতে শুরু করে দেয় অর্ণব। কাল ভোরে বেরুতে হবে। বাড়ি পৌঁছে, প্রচুর কাজে নেমে পড়তে হবে। ভোরের ট্রেনটা ধরতেই হবে কাল।  

আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সেন্টার থেকে ডাক এল বুঝি? এমার্জেন্সি? নাকি, রাতের খাবার দিতে মাসি এসেছে? এত তাড়াতাড়ি?  

স্যুটকেস ফেলে রেখে দরজা খোলে অর্ণব। খুলেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। গিরি! একমুখ হাসি নিয়ে দরজার বাইরের টিমটিমে বাল্বের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

“তুমি? কী ব্যাপার? এত রাতে এখানে?” হকচকিয়ে প্রশ্ন করে অর্ণব।

“মাপ করবেন ডাক্তারবাবু। কাল চলে যাবেন, তাই এগুলো দিতে এলাম। প্রেস্ক্রিপশনে ওষুধ লেখা থাকে, ভবিষ্যৎ তো লেখা থাকে না!” কথাগূলো বলেই দু’হাত ভর্তি থলের সম্ভার তুলে ধরে সে। অর্ণবের চোখ চলে যায়। অনেকগুলো লাল রঙের কাপড়ের ব্যাগ।  ‘ধর্মরাজ গিরি শাড়ি স্টোর্স’ ছাপ মারা।

“এগুলো কী, গিরি?”

“আজ্ঞে, প্রণামী। তালা দেওয়ার সময় তো হয়ে এসেছে, তাই শাড়ির দোকানটা তুলে দিলাম আজীবনের জন্য। আমার শেষ সম্বল এই শাড়িগুলো শো-কেসে পড়ে ছিল। বিশ্বাস করুন। নতুন। বিক্রি হয়নি। তাঁতের। তাঁতিবাড়ি থেকে বুনিয়ে আনা। দেখবেন, বাড়ির সকলের খুব পছন্দ হবে। আর এই যে এই ব্যাগটা, এটা নতুন বৌমার জন্য। একটাই ঢাকাই জামদানি ছিল দোকানে। ভাতকাপড়ে দেবেন ওঁকে। বলবেন, ওঁর এক ভাসুর আশীর্বাদীতে দিয়েছে। আয়ু ফুরিয়ে আসা একটি লোকের দেওয়া অক্ষয় জীবনের আশীর্বাদ। আপনি আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন এতদিন। আমার অনেক ঋণ আপনার কাছে। আর যদি দেখা না হয়... তাই দিয়ে গেলাম। আপনি গোছগাছ করুন। আমি আসি।”

অর্ণবের হাতে থলির সমাহার গচ্ছিত করে ফিরে যায় গিরি। ‘ধর্মরাজ গিরি’-র ধর্মত যথার্থ উত্তরসূরী।

ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খায় অর্ণব। কয়েক মুহূর্তের এই ঘটনার অভিঘাতে আচমকা ঝাপসা হয়ে আসে ওর সংবেদনশীল চোখ। দেখে, আবছা অন্ধকারে হাসতে হাসতে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা অস্পষ্ট বাস্তব, কর্কট রোগের বিষে নীল হয়ে যাওয়া একটা লোক... যে লোকটা হয়ত আর সাত দিনও বাঁচবে না...  

Comments

বিষাদ রঙে প্রলিপ্ত এক মানবিক দলিল। রহস্যই জীবনের প্রাণ...কখন যে ঘনিয়ে উঠবে, কখন যে আলগা হয়ে যাবে, এসব জানা থাকেনা বলেই মানুষ ছুটে চলে, চলার সামর্থ্য পায়...

আরও পড়ুন

সৌমাল্য গরাই

কবিতা সিরিজ

কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৪

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৮

একটি কবিতা সিরিজ —

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ২

“মহানগর” - ধীমান ব্রহ্মচারী | পর্ব ৬