ছোট গল্প— হেমন্ত সরখেল
জটামসি
স্নান সেরে ঘরে এল তারকেশ্বরী। ওয়াল ক্লকে সাড়ে এগারোটা। বাঁ হাতের কনুইটা জ্বলছে। মন্দিরের মেঝেতে ঘষে গেছে সতর্কতা সত্ত্বেও। বিরক্ত মুখে বেটাডিনের টিউবটা বের করতে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারটা টানলো। একটা চিরুনি! কে রাখলো!এর প্রয়োজন তো আজ বাইশ বছর হলো শেষ। তবে, রাখলো কে! কার স্পর্ধা হবে এমন মস্করার! চাপা গলায় হিস হিস করে উঠলো,
— ধামী!অ্যাই ধামী...
— আসি মা...
কথার সাথেই ছিটকে ঢুকে এলো তন্বী, শঙ্খচূড়ের গতি। তেমন সাবধানী। চলমান তমসা।
— কী হলো?
— এই দ্যাখ্! ড্রয়ারে এটা কী? কে ঢুকেছিল ঘরে?
— কিসের কথা বলছো?
ড্রয়ারে চোখ রেখে প্রশ্ন করতেই পেছন থেকে চুলের ঝুঁটি চেপে ঝুঁকিয়ে দিল ড্রয়ারের দিকে তারকেশ্বরী। তর্জনী ইঙ্গিতে চিরুনিটা দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো—
— কী এটা!
— চিরুনি! কিন্তু এ-এটা তো...,আর তোমার ড্রয়ারেই বা কিভাবে এল, কেউ তো আসে না,আসেনিও এ ঘরে,তাহলে...!
— সরা, সরিয়ে নে আগে এটা! তুই জানিস না কত বড়ো শত্রু এ আমার?
চিরুনিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ধামী। পালঙ্কে বসে পড়লো মা, মা তারকেশ্বরী। শরীর ছেড়ে দিলো পেছনে, আধঝোলা পা,মেঝের কাছে। কে এসেছিল ঘরে!
নিশিকান্ত পুরুষ কম স্বামী অধিক। ভ্যান টেনে নতুন বৌয়ের আলতা-সিঁদুর, টায়রা-টিকলি, কোমরছাপা একরাশ চুলের রাঙাজবা তেলের পর সিনেমার টিকিটের আর দাম পকেটে থাকে না।স্বভাবতই কাঠিন্যের মেঘ জমে রাতের আঙিনায়। এভাবেই কবে যেন চর পড়ে গেল সম্পর্কের নদীতে আর আগাছা ঠেলে উঠে এল দুলু, ভাসিয়ে নিলো শিউলিকে। ও রংয়ের কাজ করে, কাঁচা পয়সা মুঠো মুঠো। এক ভোরে নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্নে ঘর ছাড়লো শিউলি আর ৯ দিনের দিন,সন্ধেবেলায় আরও তিনজন এসে ওকে নিয়ে পাড়ি দিলো ভিন দেশে। সেখানে শরীর যায়, মন যায়, সম্ভ্রম যায় কিন্তু টাকা আসে, আসে টাকা, দেদার টাকা। সারাদিন আয়নার সামনে বসে প্রসাধনী আর চিরুনি ঝলসায়। এখানেই একদিন গৌরী এল,গুজগুজ ফুসফুস। গৌরী স্বপ্ন দেখায় শিউলিকে। স্বাধীনতার কথা শোনায়, বলে মুক্তির স্বাদের কথা। নারী হয়ে জন্মেছিস,শক্তির আধার তুই। তোর মাঝেই তাবৎ দেবী বিরাজমান। শুধু তুই তাকে চিনতে পারছিস না বলে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিস। আজ এ লোক কাল সে লোক। গতর ফুরালে তখন কী হবে! এঁটো পাতার মতো উড়ে যাবি অবজ্ঞার হাওয়ায়।
ভাবনায় ফেললে দেখছি! কথাগুলো তো উড়িয়ে দেওয়ার মতো না! নিত্যনতুন কচি মুখের ভীড় জমছে এখানেও। তাদের তিরছি নজরের ডাকে মাঝে মাঝে বাঁধা কাস্টমারও খিসকে যাচ্ছে। বলে, বাঁধন ঢিলে হলে আর তোমার কাছে পাব কী? ঢাকের চামড়া টানটান না থাকলে আকর্ষণের বোল বের হয় না, তখন আর বাজিয়ে তেমন সুখ কোথায়! অন্যদিকে, গৌরীর কথায় একছত্র শাসনের ইঙ্গিত ভাসে। সুরক্ষিত ভবিষ্যতের হাতছানি থেকে থেকে দোটানায় ফ্যালে ওকে। পরপর কয়েকটা দিন টানাপোড়েনের এই অনভিপ্রেত উদাসীনতায় বিরক্ত হল গ্রাহকেরা। মাসির কাছে নালিশ গেল। সেও বিরক্ত! গতরখাকির এ কোন নতুন ঢং! এদিকে ভিক্ষের ছলে নিত্য আসে গৌরী। টাকা আর মন্ত্রণা আদান-প্রদান হয়। যত হয়, তত ঝোঁকে শিউলি সেদিক পানে। একদিন যা ঘটার তাই ঘটলো। চোখের ইশারায় প্রোগ্রাম সেট হল আর এক জমজমাট উতরানো সন্ধেয় গৌরীর সাথে আবার তৃতীয় ঘরের ডাকে ঘর ছাড়লো মুক্তির আস্বাদ পেতে। আরও বেশি স্বাধীনতা, আরও বেশি কর্তৃত্ব, আরও বেশি শাসনক্ষমতার ডাকে,নতুন ঘরের চালায়।
মা গৌরী, দিনে পুজোয় ব্যস্ত, রাতে ভর পড়ে। দলে দলে জমা হওয়া অসহায় আগন্তুকের ত্রাতা। কারও জামাই নিরুদ্দেশ, কারও বৌমা বাঁজা, কারও বাচ্চা ভোঁদাই, কারও অর্থকষ্টের শেষ নেই। কেউ জর্জরিত মামলা-মোকদ্দমায়,কেউ অসুখ-বিসুখে। গৌরী সমাধান বাৎলায়, শতকরার হিসেবে আনা-পোয়া ঠিক হলেই 'কাজ-এ' জোয়ার চলতে থাকে। কখনও ভয়, কখনও সাবধানবাণী আবার কখনও বা সান্ত্বনায় অভয় বিস্তার লাভ করে সাঁঝের আলো-আঁধারিতে, মন্দিরের উঠোন জুড়ে। মা গৌরী আত্মপ্রসাদে তৃপ্ত হয়ে জাঁকিয়ে বসেন নিজের পীঠ-এ।
মন দিয়ে 'কাজ' শিখলো শিউলি। শিখলো,চুলে তেল দেওয়া চলবে না। ধীরে ধীরে তাতে জট পড়বে। পড়ুক, না পড়লেই ক্ষতি। যত তাড়াতাড়ি পড়ে ততই সুবিধে। সেদিক থেকে নজর সরাতে হবে। আয়েশ করে পান সেজে খেতে শিখতে হবে। মুখে হাসি এবং শাসন সাজিয়ে রাখতে হবে যুগপৎ। ক্ষণে ক্ষণে যেন চোখ ঝলসায়,শিখতে হবে। যখন ভর পড়বে গৌরী তখন অসহায় দুখী মানুষদের দিকে তাকাতে হবে পরম মমতার চোখে। বিশ্বাস জন্মানোর মতো পরিবেশ তৈরি করা চাই, এখানেই তোমার যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে। সব জ্বালার উপশম ঘটাবেন মা গৌরী দেবী মনসার কৃপায়।
শুধু শিউলিই না, এমন আরও কয়েকজন গৌরীর সহচরী। শাখাপ্রশাখা থাকে ঝাঁকড়া গাছের। নতুন একজনের আগমন ঘটল। এ মেয়েটাকে চেনে শিউলি। স্বামী মারধর করে বলে প্রায়ই আসতো একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে।পরিচয় দিত পিসতুতো ভাই। অনেকদিন ধরেই চলছিল ওর ঘ্যানঘ্যান। একদিন ভর পড়ার আগে গৌরী ডাকল শিউলিকে। বলে দিল,যদি আজ আবার সে আসে তাকে যেন থাকতে বলা হয়। কাজ সেরে, কথা বলতে চায় ওর সাথে গৌরী। যথারীতি সে এল। অপেক্ষা করলো এবং প্রায় ঘণ্টা তিনেক গোপন কথার শেষে ফিরে গেল। আবার ভুস্ করে ভেসে উঠল মাস চারেক পর। ওকে নাকি মা স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন মা গৌরীর চরণে আশ্রয় নিতে। গৌরীর পা দুটো ধরে সে কি আছাড়ি-পিছাড়ি!বহু মিনতি, সাধ্য-সাধনার পর মায়ের মন গললো। সর্বসমক্ষে শিউলিকে বললেন, কী আর করা! রেখে নে নিজের কাছে, বলছে, মা নাকি আদেশ দিয়েছেন! সে আমি শুনে নেব'খন। না হলে তো শাস্তি পাবেই!
রয়ে গেল ধামী। শুধু রয়েই গেল না, অনেকটা প্রতিপত্তির সাথেই রইল। মায়ের আদেশে যে এসেছে তার জায়গা তো আলাদা হবেই! কত ধ্যাষ্টামো যে জানো গো মা! হি হি করে হাসে শিউলি গৌরীর সামনে।এদিক ওদিক তাকিয়ে কপট রাগে তর্জন করে গৌরী, চুপ কর! একটু দূর থেকে দুজনকে দেখে মিটমিট করে হাসে বিধবা ধামী। সাথের ছেলেটা,যার নাম পরেশ, গৌরী মায়ের ফাই-ফরমাস খাটে আর ধামীকে মন্দির থেকে দূরে ঘন বেত জঙ্গলের আড়ালে বেলতলায় সোহাগ করে। শিউলির লোভ হয়। কতদিন হয়ে গেল… মা! মা মাগো মা, মাঝে মাঝেই জোরে চেঁচিয়ে ওঠে গৌরী আর, নিজেকে সম্বরণ করে শিউলি। ইচ্ছে মরা নদীর মতো সরু হতে হতে ফুরিয়ে যায়।
শরীর ভালো যায় না আজকাল মায়ের। এরই মাঝে একদিন মন্দিরভরা ভক্তদের সামনে মা শিউলির দেহে এলেন। সমস্ত ভক্তেরা মা'কে নতুনভাবে চিনলো। মা গৌরী ভক্তদের জানালেন মায়ের এখন এটাই ইচ্ছে। তাই তিনি মাঝে মধ্যেই শিউলিকে নিয়ে সাধনায় বসছেন। মাতৃ আরাধনার, এক্ষেত্রে বিশেষ গূঢ় পদ্ধতি আছে। তাও আবার, মা'কে নিজদেহে আশ্রয় দেওয়া সহজ তো নয়!
ভয় পাচ্ছে শিউলি। খুব ভয়। ওর সারা শরীর বেয়ে চলাফেরা করে গৌরী নামক একটা নিস্তেজ শঙ্খচূড়। ক্ষমতা হারানোর জ্বালা চোখের মণিতে দেখতে পায় গৌরীর। অসহায় গৌরী, ছেড়ে যে দিতেই হয় স্থান নিজের হাতে তৈরি করা শিষ্যাকে। তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হয় আর চুপটি করে বসে থাকতে হয় বিপদ-আপদ সামলাতে অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে। ধীরে ধীরে বড়োমা হয়ে ওঠে গৌরী আর, কণ্টকাকীর্ণ পথে বুকে হেঁটে,নিজেকে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত করে বড়ো হতে থাকে শিউলি, আগামীর একটা ভয়াল সরীসৃপ। সব জানে শিউলি। তাই ভয় পাচ্ছে। যদি কোন অসতর্ক মুহূর্তে সব হারানোর রাগে ওকে ঝট্ করে মুখে পুরে নিতে চায় সাপটা! শঙ্খচূড় অনায়াসে গিলে নেয় আরেকটাকে। তাছাড়া, গৌরীর প্রদীপ নেভার আগে একবার তো দপ্ করে সে জ্বলে উঠবেই! এ যে প্রাকৃতিক বিধান। নাঃ! ভাবতে হবে কিছু। ভাবনারা হিল্লোল তোলে, কপালের বলিরেখা গভীর হতে হতে হঠাৎই চোখ পড়ে ধামীর ওপর। এই তো মুস্কিলআসান!
সবটা বুঝেই একদিন গৌরীর অজান্তে ঘর ছাড়লো আবার শিউলি, নিজস্ব আশ্রমের পানে। গৌরীর ধনে যে ওরও অধিকার আছে সেটা বুঝে,বুঝিয়ে চলে এল আজকের দেউলে, এখন ও পাকাপোক্তভাবেই ভর পড়তে পারে। এখন ও মা তারকেশ্বরী। আজকাল শুধু ওর সাধের কেশদামের জন্য ওর কষ্টটা উথলে উথলে ওঠে ! একদিন এই চুলের গোছেই ও মন জয় করেছিল দুলু'র। এই চুলেই জমাট বেঁধে থাকতো খদ্দের। আজ সে চুল গেছে কিন্তু তার হুতাস বর্তমান। পাকা ফোঁড়ার মতো টিস্ মারে মনে। চাপা দীর্ঘশ্বাস আটক থাকে নিজের ভারি বুকেই,যাক্ গে! কি আর করা যাবে! যে লুকোনো বৈভব ও জমা হতে দেখেছে গৌরীর থানে, সেটা পেতে গেলে এসব ভাবলে কি চলে!একটা দুঃখ জয়ের রাস্তায় নেমে অন্য দুঃখে দুখী হওয়ার কোন মানে নেই।
ধামী জানে, একমাত্র চিরুনিই তারকেশ্বরীকে শিউলি'তে টেনে আনতে পারে, আর, সেটা না হলে আজ ও এখান থেকে পালাতে পারবে না। দুপুরের ভাত ঘুমের পর মা মন্দিরে যেতেই পরেশকে দিয়ে কিনে আনানো চিরুনিটা চট করে ড্রয়ারে রেখে চলে এল মন্দিরে। চাবি দিল মায়ের হাতে। জানতো, ভর সেরে ফিরে স্নানের পর তারকেশ্বরী আজ শিউলি হবে। প্রতিদিনই বেটাডিন লাগে, আজও শরীরের কোথাও কাটবে,ছড়বে,ফাটবে। তারপর ড্রয়ার খুলবে, খুলেই শিউলি হবে।
একটু একটু করে সরিয়ে নেওয়া ধন পৌঁছে গেছে সুরক্ষিত হাতে। এবার ওর সরে পড়ার পালা। পরেশ ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি দিতেই ও শেষবারের জন্য মায়ের ঘরে ঢুকলো। চিত হয়ে শোওয়া, পা দুটো ঝুলছে পালঙ্ক থেকে নিচে। মুখে চোখ পড়তেই শিউরে উঠলো, মুখে গ্যাঁজলা, একটা শিশি ডান হাতের সামনে, বাঁ হাতে একটা- চিরুনি। ঘর থেকে বেরিয়ে ও পরেশকে ইশারায় ডাকলো,
— একবার থানায় যা, মা বিষ খেয়েছে, আমার আর তোর সাথে যাওয়া হলো না...
ধামী ভর পড়তে শিখেছে, শুধু জটা এখনও তেমন সভ্য হয়নি, এই যা। তবুও, ওকেই এখন দেউল সামলাতে হবে। মা হতে হবে।
Comments